সুখবর

অসহায় নারীদের প্রেরণা ‘জয়িতা’ শম্পা গোস্বামী 

২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে শম্পা তাঁর পাঁচ ছাত্রীকে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থা

স্বল্প মূল্যের স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছেন প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থার নারীরা। তাঁদের সঙ্গে শম্পা গোস্বামী
ছবি: প্রথম আলো

সাতক্ষীরার দেবহাটা সদর গ্রামের মেয়ে শম্পা গোস্বামী (৪১)। এ অঞ্চলে এখন অনেকেই একনামে চেনেন তাঁকে। অদম্য ইচ্ছাশক্তি যে একজন নারীকে কীভাবে বাধার পাহাড় পেরিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারে, সেই প্রেরণার নাম এখন তিনি।

মাত্র সাড়ে ১৫ বছর বয়সে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মা–বাবা বিয়ে দিয়ে দেন তাঁকে। এরপরও ভেঙে পড়েননি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। ২০০২ সালে কালীগঞ্জ মোজাহার মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে যান। কিন্তু তাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে এলাকার নারীদের উন্নয়নে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও শ্যামনগর, আশাশুনি ও সাতক্ষীরা সদরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারীদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে পরামর্শ, সহিংসতার শিকার নারীদের আইনি সহায়তা, কৃষিকাজে নারীদের উদ্বুদ্ধ করা, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহযোগিতা করাসহ নানা বিষয়ে কাজ করছে তাঁর সংগঠন ‘প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থা’। সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য ২০২২ সালে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর থেকে জেলা পর্যায়ে তাঁকে দেওয়া হয়েছে জয়িতা পুরস্কার।

শুরুর কথা

বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার পর নিজের অসহায়ত্বের অভিজ্ঞতা থেকে শম্পা গোস্বামী অসহায় নারীদের সাহায্য করা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার তাগিদ অনুভব করতেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরুতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে রক্তদান ক্লাব, ঝরে পড়া ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর নানা উদ্যোগ নেন। এসব কাজ করতে গিয়ে অসহায় পরিবারগুলোর সংগ্রাম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তাঁর। বিশেষ করে নারীদের অসহায়ত্ব তাঁকে কিছু করার জন্য ভাবায়। এ জন্য বড় পরিসরে কাজের জন্য প্রয়োজন অনুভব করেন একটি সংগঠন তৈরির।

২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে শম্পা তাঁর পাঁচ ছাত্রীকে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থা। সংগঠনটির জন্য সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলা সদরে মহৎপুরে একটি কার্যালয় খোলেন। প্রথমে নিজের জমানো ৩০ হাজার টাকা ও কয়েকজনের কাছ থেকে আরও ২০ হাজার টাকা অনুদান নিয়ে সাতজন অসহায় নারীকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শপিং ব্যাগ তৈরি ও বাজারজাত করা আরম্ভ করেন। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে পরিসর।

১০ বছরের ব্যবধানে শপিং ব্যাগ তৈরি ছাড়াও প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থা এখন স্বল্প মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন, মাস্ক, নকশি কাঁথা ও নানা ধরনের হস্তশিল্পসামগ্রী, সুন্দরবনের মধু ও বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি ও বাজারজাত করছে।

এর বাইরে তাঁর গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কোস্টাল ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে উপকূলের মানুষের কী কী করা দরকার, সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে।

বেড়েছে কাজের পরিধি

প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থায় এখন কাজ করছেন ২২ জন স্থায়ী কর্মী। অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন আরও তিন শতাধিক কর্মী। এ ছাড়া রয়েছেন দুই শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক।

আমেনা খাতুনের (৩০) বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলা কুলিয়া দুর্গাপুর গ্রামে। তাঁর স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন আমেনার শ্বশুর, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর দুটি পা অচল হয়ে যায়। এ অবস্থায় আমেনাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। আমেনা খাতুন জানান, সংসারের যখন অচল অবস্থা, তিনি তখন শরণাপন্ন হন প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থার। বর্তমানে তিনি শপিং ব্যাগ সেলাই করে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় করছেন। এতে তাঁর সংসার খরচ চলছে।

কালীগঞ্জ উপজেলায় বাজারগ্রাম রহিমপুরের নাজমা খাতুন ও মহৎপুর গ্রামের নাজমুন নাহার একসময় প্রেরণায় শপিং ব্যাগ তৈরির কাজ করতেন। এখন তাঁরা নিজেরাই শপিং ব্যাগ তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছেন।

এই ধরনের কয়েক শ নারীর জীবন বদলে দিয়েছেন শম্পা গোস্বামী। শম্পা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, সমাজে বেশির ভাগ গরিব নারীরা বৈষম্যের শিকার হন। মূলত ওই সব বৈষম্যের প্রতিকূলে গিয়ে নারীদের স্বনির্ভর করতে চান তিনি। তাঁর স্বপ্ন ‘প্রেরণা’ একদিন দেশের বড় সংগঠনগুলোর একটি হবে। তবে তাঁর একার পক্ষে দেশের সব অসহায় ও বিধবা নারীদের ভাগ্য বদল করা অসম্ভব। এ জন্য সরকার ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।