রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছে রাজশাহীর সচেতন ব্যবসায়ী মহল। তারা আজ বুধবার এই দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপি রাকাবের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছে। এতে স্বাক্ষর করেছেন রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান।
রাজশাহীর সচেতন ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের দোরগোড়ায় স্বল্প সময়ে ও সহজ শর্তে ঋণসুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিকেবির সব দায় ও সম্পদ নিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ৫৮ নম্বর অধ্যাদেশ মূলে ১৯৮৭ সালের ১৫ মার্চ রাকাব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে রাকাব রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলায় ৩৮৩টি শাখার মাধ্যমে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে।
অতিসম্প্রতি রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এমন সিদ্ধান্ত উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন স্বার্থবিরোধী ও আত্মঘাতী। রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত না করার জোর দাবি জানান তাঁরা। উত্তরবঙ্গের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী সমাজসহ রাজশাহীবাসীর জোর দাবি রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিলের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানায়।
স্মারকলিপিকে তাঁরা রাকাব-বিকেবি একীভূত না করার পক্ষে ১১টি যুক্তি তুলে ধরেন।
যুক্তি এক. ব্যাংক একীভূতকরণের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো একটি বৃহৎ ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে অপর একটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করা। তবে বিকেবির মতো একটি বৃহৎ লোকসানি ব্যাংকের সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করা হলে একীভূতকরণের সুফল অর্জন সম্ভব হবে না।
দুই. বিকেবির প্রতিবছর লোকসানের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে রাকাব বিগত তিনটি অর্থবছর থেকে অপারেটিং মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। রাকাবের লোকসানি শাখার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। প্রত্যাশা করা যায়, আগামী দুই বছরের মধ্যে এ ব্যাংকে কোনো লোকসানি শাখা থাকবে না। ব্যাংকটি চলতি অর্থবছরে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পরিচালিত হবে এবং আগামী অর্থবছরে নিট মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
তিন. আর্থিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন সূচকে বিকেবির তুলনায় রাকাব ভালো অবস্থায় আছে। একটি দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করা হলে বিগত কয়েক বছরে রাকাবের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ম্লান হয়ে যাবে। একীভূত করা হলে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ মূলধন-ঘাটতি ও ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান কাটিয়ে মুনাফা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
চার. কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কৃষিভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা বর্তমানের চেয়ে অনেকাংশে মন্থর হয়ে পড়বে। ফলে এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পাঁচ. রাকাবের প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এমনকি রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা দূরীকরণসহ উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান সম্ভব হয়েছে। ব্যাংক দুটিকে একীভূত করা হলে চলমান অগ্রগতির ধারা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।
ছয়. পারস্পরিক তুলনায় রাকাবের ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন-ঘাটতি এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে, যা দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পূরণ করা সম্ভব বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনে করে। অপর দিকে বিকেবির ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন-ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
সাত. রাকাব অনলাইনের মাধ্যমে ঋণ শ্রেণীকরণ স্বচ্ছতার সঙ্গে সঠিকভাবে সম্পন্ন করে থাকে। বিকেবিতে শ্রেণীকৃত ঋণ গোপনের সুযোগ রয়েছে। অতিসম্প্রতি বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদ থেকে জানা যায়, বিকেবি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা শ্রেণীকৃত ঋণ গোপন করেছে। এদিকে রাকাবের কোনো লুক্কায়িত শ্রেণীকৃত ঋণ নেই।
আট. অদ্যাবধি রাকাবের অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেমে Cyber Attack সফল হয়নি। অপরদিকে বিকেবির সিস্টেম সম্প্রতি Hacked হয়েছে।
নয়. বিকেবি কর্তৃক ৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা শ্রেণীকৃত ঋণ গোপন করায় ব্যাংকটির প্রভিশন-ঘাটতি ন্যূনপক্ষে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা হবে। এদিকে রাকাবের কোনো প্রভিশন ঘাটতি নেই।
দশ. রাকাব দেশের একমাত্র ব্যাংক, যার প্রধান কার্যালয় রাজধানী ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে অবস্থিত। ব্যাংকটির নামের শুরুতে ‘রাজশাহী’ শব্দটি সংযুক্ত থাকায় বর্তমানে রাকাব রাজশাহীর ঐতিহ্যের অংশ। ব্যাংকটি নিয়ে আঞ্চলিকতা ও আবেগ সম্পৃক্ত। অন্য ব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাংকটিকে একীভূতকরণের সিদ্ধান্তে আমরা সচেতন ব্যবসায়ী মহল অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ।
এগারো. রাকাব-বিকেবি একীভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীতে অবস্থিত রাকাবের প্রধান কার্যালয় বন্ধ হলে রাজশাহীতে কর্মরত ব্যাংকটির প্রায় ৩০০ জন কর্মকর্তার পদ শূন্য হবে। এতে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকাসহ পুরো রাজশাহী অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে।