নৌকাডুবির মারা যাওয়া দুই কাকাতো বোন কবিতা ও পুতুলের শোকে শিশু সুবর্ণার আহাজারি। গতকাল পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গুরু গোবিন্দ গ্রামে
নৌকাডুবির মারা যাওয়া দুই কাকাতো বোন কবিতা ও পুতুলের শোকে শিশু সুবর্ণার আহাজারি। গতকাল পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গুরু গোবিন্দ গ্রামে

সন্তানহারা মা–বাবার চোখে বইছে করতোয়ার ধারা

করতোয়ার জলধারা শুকিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে তলদেশ। কিন্তু নৌকাডুবিতে সন্তানহারা মা–বাবার চোখের জলধারা কিছুতেই থামছে না। স্বজন-প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।

গত রোববার দুপুরে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীতে শতাধিক মানুষ নিয়ে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকা ডুবে যায়। যাত্রীরা সবাই মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘটনার দিন ওই নৌকায় প্রায় ১০৫ জন যাত্রী ছিলেন বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে ৬ জন সাঁতরে পাড়ে উঠেছিলেন, ২৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং এখনো ১ শিশুসহ ৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ২১, নারী ৩০ জন ও পুরুষ ১৮ জন।

১৮টি পরিবার তাদের শিশুসন্তান হারিয়েছে। সেসব পরিবারের মধ্যে ৬টি পরিবার হারিয়েছে তাদের একমাত্র সন্তানকে। দুটি সন্তানের দুটিই মারা গেছে ৩টি পরিবারের। বাকি ৯টি পরিবার তাদের একাধিক সন্তানের মধ্যে একটি করে শিশুসন্তান হারিয়েছে। ৩টি পরিবারে সন্তানের সঙ্গে মারা গেছেন মা অথবা বাবাও। সন্তান হারানো পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

মারা যাওয়া শিশুদের বয়স বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১১, ১৬ ও ১৭ বছরের শিশু মারা গেছে ১ জন করে (৩ জন); ২, ৫, ৬, ১৪, ১৫ ও ১৮ বছর বয়সের মারা গেছে ২ জন করে (১২ জন) এবং ৩ ও ১০ বছরের শিশু মারা গেছে ৩ জন করে (৬ জন)।

একমাত্র বা দুটি সন্তানের দুটিকেই হারানো পরিবারগুলোর কান্না বাঁধ মানছে না কোনো সান্ত্বনায়। বোদা উপজেলার গুরু গোবিন্দ্র গ্রামের বাসিন্দা হোটেলশ্রমিক রামবাবুর দুটিই সন্তান—কবিতা রানী (১১) আর পুতুল রানী (১৪)। দুই মেয়েকে নিয়ে রামবাবু বড় স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু গত রোববার করতোয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ হয় কবিতা ও পুতুল। পরের দিন আউলিয়া ঘাট থেকে তাদের লাশ উদ্ধার হয়। দুই মেয়েকে হারিয়ে রামবাবু ও তাঁর স্ত্রী প্রতিমা রানী এখন পাগলপ্রায়। রামবাবুর ভাই রতন বর্মণের মেয়ে সুবর্ণার বয়সী ছিল কবিতা। গতকাল শুক্রবার সকালে কথা হয় সুর্বণার সঙ্গে। এ সময় সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বলে, ‘আপুক কুনঠে পামো। অ্যালা মুই কার সঙ্গে কথা কইম?’

বোদা উপজেলার গুঞ্জরপাড়া এলাকার বাসিন্দা কলেজশিক্ষক রমেশ চন্দ্র বর্মণ ও মিনতি রানী দম্পতি তাঁদের দুই সন্তানকেই হারিয়েছেন। ছেলে জ্যোতি মৃন্ময় রায় (১৫) বোদা পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল, আর মেয়ে উশশী রায় (৬) মন্দিরভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে পড়ত। সেদিনের নৌকাডুবিতে তারাও মারা যায়। দুই সন্তানকে হারিয়ে রমেশ ও মিনতির কান্না থামছে না। মিনতি রানীর ভাই দীপক চন্দ্র রায়ও তাঁর দুই মেয়ে দীপশিখা রায় (১০) ও ভূমিকা রায় পূজাকে (১৫) এই নৌকাডুবিতে হারিয়েছেন। মিনতি রানী আহাজারি করছেন আর বলছেন, ‘ভগবান তুমি আমার কলিজা দুইটাকে কীভাবে কেড়ে নিলে? আমি কাকে নিয়ে বাঁচব, তা একটু ভাবলে না?’ তাঁর দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়াচ্ছে।

রোববারের নৌকাডুবিতে রতন চন্দ্র তাঁর একমাত্র মেয়ে শ্রেয়শ্রীকে (৩) হারিয়েছেন। গতকাল কথা হলে তিনি বিলাপ করে বলেন, ‘পূজা শুরু হয়ে গেইছে। বাড়িত শ্রেয়শ্রী নাই। আসিবেও না কোনো দিন। এই কষ্টলা মুই সহিবা পারছুনি।’ তিনি আরও বলেন, মেয়ে পূজায় নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার বায়না ধরেছিল। মহালয়া শেষ হলেই সেটা কিনে দিতে কথা দিয়েছিলেন। কাপড় কেনার টাকা জোগাড়ও হয়েছিল। কিন্তু মহালায়ার দিনেই মেয়ে হারিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব।

নৌকাডুবিতে খেলার সাথীর মৃত্যু ভুলতে পারছে না এই শিশু। গতকাল পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার গুরু গোবিন্দ গ্রামে

একমাত্র সন্তান সূর্য মোহন রায়কে (৬) হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ বংশীধর পূজারী গ্রামের বিমল চন্দ্র রায় ও প্রতিমা রানী দম্পতি। বিমল বলেন, ‘নৌকাডুবির আগপর্যন্ত ছেলে আমার কোলেই ছিল। জলে পড়ে যাওয়ার সময় অনেক মানুষ আমার ওপরে পড়ে যায়। সে সময় ছেলে কীভাবে যেন হারিয়ে গেল।’ বলেই তিনি কাঁদতে থাকেন। তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে যেন আর কোনো মা-বাবার বুক খালি না হয়।’

একমাত্র সন্তানের সঙ্গে কেউ কেউ হারিয়েছেন স্বামী অথবা স্ত্রীকেও। সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলের দেবীগঞ্জ উপজেলার মধ্য শিকারপুর গ্রামের অমল চন্দ্র বর্মণ। করতোয়ার নৌকাডুবিতে একমাত্র ছেলে দীপ বাবুর (১০) সঙ্গে অমল চন্দ্রও মারা গেছেন। স্বামী ও ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন দিপালী রানী। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁকে বোঝাতে পারছেন না। তিনি আহাজারি করে বলছেন, ‘তোমার দাদা হামাক ছাড়ি গেইল। সাথে ছোয়াটাকও ধরি গেইল। অ্যালা হামাক কায় দেখিবে? হামার সব শেষ হয়ে গেইল।’

বোদা উপজেলার মাড়েয়া শালবাড়ী গ্রামের প্রফুল্ল রায়ের একমাত্র ছেলে সুব্রত রায়ের (২) সঙ্গে স্ত্রী সুচিত্রা রানীও মারা গেছেন। একইভাবে দেবীগঞ্জ উপজেলার ছত্রশিকারপুর হাতিডোবা গ্রামের রবিন বর্মণের একমাত্র ছেলে বিষ্ণু বর্মণের (৩) সঙ্গে তাঁর স্ত্রী তারা রানীও মারা গেছেন।

এ ছাড়া এই নৌকাডুবির ঘটনায় বোদা উপজেলার ফুটকিবাড়ি গ্রামের হেমন্ত কুমারের মেয়ে শ্যামলী রানী (১৪), কাউয়াখাল গ্রামের রহিন চন্দ্রের ছেলে সজীব রায় (৮), বামনহাট গ্রামের লেবু রায়ের মেয়ে আঁখি রানী (১৬), জয়নন্দ বড়ুয়া গ্রামের বসন্ত বর্মণের মেয়ে ধুতি রানী (১০),  দেবীগঞ্জ ছত্রশিকারপুর হাতিডোবা গ্রামের বাবুল বর্মণের একমাত্র ছেলে দীপংকর (৩), শালডাঙ্গা হাতিডোবা গ্রামের নারায়ণ চন্দ্রের মেয়ে তনুশ্রী (৫), ছত্রশিকারপুর গ্রামের ধর্ম নারায়ণের মেয়ে প্রিয়ন্তি (৮), একই গ্রামের বিলাশ চন্দ্রের মেয়ে দোলা রানী (৬), পশ্চিম শিকারপুর গ্রামের পূর্ণ চন্দ্র রায়ের ছেলে পলাশ চন্দ্র (১৭) এবং পঞ্চগড় সদরের ঘাটিয়ার পাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের মেয়ে যূথী রানীর (২) লাশ উদ্ধার হয়েছে। যূথীর বোন জয়া (৪) নিখোঁজ রয়েছে। তার খোঁজে ধীরেন্দ্রনাথ করতোয়ার পাড়ে প্রতিদিন অপেক্ষা করে ফিরে যাচ্ছেন।

সন্তান হারানো পরিবারগুলোর ব্যাপারে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২১টি শিশু রয়েছে। নিখোঁজের মধ্যে আরও এক শিশু রয়েছে। যেসব পরিবার তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন, তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছুই বলার নেই।

সর্বশেষ গত বুধবার বিকেলে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধারের পর থেকে আর কোনো লাশ উদ্ধার করা হয়নি। শুক্রবার ষষ্ঠ দিনের উদ্ধার অভিযানে দুটি সাইকেল ও একটি হলুদ রঙের শাড়ি উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও ডুবুরিরা। নিখোঁজ তিনজনের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী, নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ তিনজন হলেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত-কাজলদিঘী ইউনিয়নের ঘাটিয়ার পাড়া এলাকার শিশু জয়া রানী (৪), দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডোবা-ছত্রশিকারপুর এলাকার ভূপেন্দ্র নাথ বর্মণ (৪২), বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া এলাকার সুরেন্দ্রনাথ বর্মণ (৬৫)।