ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন যশোর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আশপাশে ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগ পরিচয়ে ছাত্রাবাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একদল সন্ত্রাসী। জোর করে ছাত্রাবাসে মাদকের আসরও বসান তাঁরা। চলে মাদকের ব্যবসাও। ক্ষমতাসীনদের মিছিল-সমাবেশে না গেলে শিক্ষার্থীদের মারধরও করা হয়।
যশোর শহরের শেখহাটি হাইকোর্ট মোড়ে সরকারি এই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অবস্থিত। শিক্ষার্থী আছেন প্রায় চার হাজার। তাঁদের বেশির ভাগ আশপাশের বাসাবাড়িতে গড়ে ওঠা ছাত্রাবাসে থাকেন। ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়ে অন্তত ২০ জন স্থানীয় সন্ত্রাসী ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের জীবন অস্থির করে তুলছে বলে অভিযোগ। ভয়ে অনেকে লেখাপড়া ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন। এমন পাঁচ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। শিক্ষার্থীরা বলছেন, শেষ ছয় মাসে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী ভয়ে ছাত্রাবাস ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব অপকর্মে জড়িত সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মোমেল হোসেন ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি তৌহিদুর রহমান ওরফে জুয়েল। তাঁরা দুজনই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। যদিও ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় একে অপরের ওপর চাপিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে মোমেল হোসেন বলেন, শহরের ঘোপ এলাকার কয়েকজন শিক্ষার্থীদের হাতে মাদক তুলে দিচ্ছে। তারাই মূলত ছিনতাই–চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। ওই সন্ত্রাসীরা তৌহিদুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করে। মোমেল হোসেন মিথ্যাচার করছেন দাবি করে তৌহিদুর রহমান বলেন, ‘এলাকার যত বখাটে ছেলে আছে সব মোমেলের সঙ্গে থাকে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মুঠোফোনে গতকাল শুক্রবার একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
প্রাণভয়ে লেখাপড়া ছেড়ে কোনো শিক্ষার্থীর বাড়ি চলে যাওয়ার তথ্য জানা নেই বলে দাবি যশোর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জি এম আজিজুর রহমানের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আমরা পুলিশকে জানাই। বাইরে কোনো ঘটনা ঘটলে তা শিক্ষার্থীরা আমাদের জানায় না। আমরা না জানলে কীভাবে পদক্ষেপ নেব?’
মেকানিক্যাল বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী জয় বালা পলিটেকনিকের ছাত্রাবাসে থাকতেন। ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা বলছেন, মাস দেড়েক আগে জয় বালাকে পলিটেকনিকের প্রধান ফটকের সামনে থেকে স্থানীয় কয়েকজন তুলে নিয়ে যান। তাঁরা অজ্ঞাত স্থানে চার-পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে ১৩ হাজার টাকা আদায় করেন। এরপর মাদক সঙ্গে দিয়ে ভিডিও করেন। কাউকে বললে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন সন্ত্রাসীরা। তবে জয় বালা ফিরে সহপাঠীদের জানালে ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধের দাবি তোলেন শিক্ষার্থীরা। এরপর প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বহিরাগত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে সন্ত্রাসীদের হুমকিতে ছাত্রাবাস ছেড়ে বাড়িতে চলে যেতে হয় জয়কে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জয় বলেন, ‘আমি হোস্টেল ছেড়ে এখন বাড়িতে আছি।’ এরপর ‘ব্যস্ত আছি’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
একই বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সল মাহমুদ ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রাবাসে থাকতেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি তিন বন্ধু মিলে বাজারে যাওয়ার সময় স্থানীয় কয়েকজন ‘এলাকার বড়ভাই’ পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেলে করে শহরের লিচুতলা এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে সবার মুঠোফোন ও ছয় হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি থানায় জিডি করেছিলেন। কিন্তু কোনো বিচার পাননি। ভয়ে ছাত্রাবাস ছেড়ে চুয়াডাঙ্গায় বাড়িতে চলে গেছেন।
টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান শহরের বারান্দিপাড়ায় একটি ছাত্রাবাসে থাকেন। মাস ছয়েক আগে ছাত্রাবাসের সামনে তাঁদের তিনজনের কাছ থেকে মুঠোফোন ও সাত হাজার টাকা ছিনতাইকারীরা ছিনিয়ে নেয়। নাঈম হাসান বলেন, ‘যারা ছিনতাই করেছিল তারা স্থানীয় যুবক। তাদের মুখ চিনি কিন্তু নাম জানি না। পরে মোমেল ভাইকে (ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোমেল হোসেন) বিষয়টা জানালে তিনি আমার মুঠোফোন উদ্ধার করে দেন। কিন্তু টাকা আর ফেরত পাইনি।’
মেকানিক্যাল বিভাগের কবির হোসেন ও মুন্না হুসাইন জামরুলতলা এলাকার ছাত্রাবাসে থাকতেন। সংসদ নির্বাচনের সময় মিছিলে যাওয়ার জন্য ‘এলাকার বড়ভাইয়েরা’ ডাকতে আসতেন। মিছিলে না যাওয়ায় একদিন পলিটেকনিক মাঠে খেলার সময় দুজনকে মারধর করা হয়। কবির হোসেন বলেন, ‘নিজেদের ক্যাম্পাসেই আমরা নিরাপদ নই। রাজনৈতিক মিছিলে না যাওয়ায় ক্যাম্পাসে খেলার সময়ে আমাকে মারধর করা হয়। এরপর ছাত্রাবাস ছেড়ে বাড়িতে চলে এসেছি।’
শেখহাটি জামরুলতলা এলাকার একটি বাড়িতে ছাত্রাবাস করে থাকতেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাঁচ শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে দুজন টেলিকমিউনিকেশন ও তিনজন কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। স্থানীয় কয়েক যুবক ‘এলাকার বড়ভাই’ পরিচয় দিয়ে ওই ছাত্রাবাসে গিয়ে জোর করে মাদক সেবন করতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, ‘রাত–দিন সময়ে অসময়ে আমাদের ছাত্রাবাসে গিয়ে এলাকার একজন মাদক সেবনের সুযোগ চাইত। ভয়ে দু–এক দিন সুযোগ দিয়েছি। পরে বাধা দেওয়ায় আমাদের মারধর করেছে। কলেজে গেলে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। ভয়ে সবাই ছাত্রাবাস ছেড়ে যার যার বাড়িয়ে চলে এসেছি।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন ছাত্রাবাসে এভাবে জোর করে মাদকের আসর বসানো হচ্ছে। এতে অনেক শিক্ষার্থীও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছেন।
পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের জন্য ২৬০ শয্যাবিশিষ্ট শহীদ অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন ছাত্রাবাস রয়েছে। মাদক, ছাত্ররাজনীতি আর বহিরাগত ব্যক্তিদের দাপটে ছাত্রাবাসটি ২০০৮ সালে বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এক যুগ পর গত বছরের ডিসেম্বরে আবারও চালু করা হয়। বর্তমানে শতাধিক শিক্ষার্থী সেখানে থাকেন। এরই মধ্যে আবার বহিরাগত ব্যক্তিদের দাপট শুরু হয়েছে।
ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা বলছেন, মাদক সেবনের নিরাপদ স্থান মনে করে বহিরাগত ব্যক্তিরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। নিষেধ করলে তাঁরা সেই শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করেন। অস্ত্র ও ছুরি দেখিয়ে মুঠোফোন, টাকা ও দামি জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা ছাত্রাবাসে এসে মারধর করে ল্যাপটপ ও টাকা নিয়ে চলে যান। না দিলে তাঁরা অস্ত্র নিয়ে ভয়ভীতি দেখান।
ছাত্রাবাস সূত্রে জানা গেছে, বহিরাগত নিষিদ্ধের ঘটনার জেরে ৩ মার্চ সন্ত্রাসীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ছাত্রাবাসে এসে জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের খুঁজে বেড়ান। না পেয়ে তাঁরা আল আমিন নামের এক শিক্ষার্থীকে তুলে পাশের হাইকোর্ট মোড়ে নিয়ে যান। পরে অন্য শিক্ষার্থীরা তাঁকে উদ্ধার করতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাঁদের মারধর করেন। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনায় ছাত্রাবাসের বাসিন্দা পাওয়ার টেকনোলজি বিভাগ থেকে সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন। শাকিল আহমেদ বাংলাদেশ কারিগরি ছাত্র পরিষদ শাখার সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, যশোর সদর উপজেলার শেখহাটি আদর্শপাড়া গ্রামের হৃদয়, সুমন, সাজিদ ও জীবনসহ স্থানীয় ১০-১২ জন প্রায়ই ছিনতাই-চাঁদাবাজি করছেন। তাঁদের ভয়ে প্রতিবছর অসংখ্য শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
৬ মার্চ যশোর সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রাবাসে সরেজমিন দেখা যায়, ছাত্রাবাসের সামনে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশের কয়েকজন সদস্য নিরাপত্তা দিচ্ছেন। এ সময় ছাত্রাবাস থেকে একটি মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসীদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোমেল হোসেন বলেন, ‘সাজিদ, হৃদয়, সুমন—তাঁরা সবাই আমার সঙ্গে মিছিল-মিটিং করেন এটা সত্য। তবে তাঁদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে আমি প্রশ্রয় দিই না। এলাকার কোনো শিক্ষার্থীর মোবাইল ও টাকাপয়সা ছিনতাই হলে আমি ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে এনে তা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’
এ বিষয়ে যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের তেমন জানা থাকে না। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যতটুকু জানায়, ততটুকুই আমরা জানি। তবে ছিনতাই–চাঁদাবাজির যেসব অভিযোগ উঠছে, সেসব বিষয়ে খতিয়ে দেখা হবে।’