রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ

জড়িতরা শনাক্ত হয়নি আজও

  • সংঘর্ষের ঘটনার দুই দিন পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমটি গঠন করা হয়।

  • দুই মাস পর ওই তদন্ত কমিটি রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। রেজিস্ট্রার সেটি উপাচার্যের দপ্তরে পাঠায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনার এক বছর পূর্ণ হয়েছে আজ সোমবার। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও তাতে কী আছে, তা জানা যায়নি। এই ঘটনা কী কারণে ঘটেছে, সেই সত্য ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম বলছেন, তিনি তদন্ত প্রতিবেদন উপাচার্যের কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। এদিকে নিয়মানুযায়ী উপাচার্যের স্বাক্ষরের পর তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হওয়ার কথা। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার ১০ মাস পেরোলেও সেটি সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হয়নি। এতে ঘটনার রহস্য যেমনি উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি, তেমনি এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

গত বছরের ১১ মার্চ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হয়। দুই মাস পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। কিন্তু আজও তা প্রকাশ করা হয়নি।

তদন্ত প্রতিবেদন কেন সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপিত হয়নি, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার মুঠোফোনে বলেন, ‘সবকিছুই সিন্ডিকেটে যায় না। ফাইল কোথায় আছে, আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। দেখতে হবে আমার দপ্তরে আছে কি না।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় উপাচার্য হয়তো সেটি সামনে নিয়ে আসতে চাইছেন না।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা বলছেন, সত্য উদ্‌ঘাটন ও তদন্তের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সেটি সত্য ধামাচাপা দেওয়ার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসন আন্দোলন স্তিমিত করার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তাঁরা।

প্রতিবেদনের বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও সহ–উপাচার্য হুমায়ুন কবীর বলেন, তাঁরা ঘটনা তদন্ত করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। পরে ঘটনার দুই মাস পর সেটি রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে জমা দেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ মার্চ সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে একটি বাসের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। এই ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। হামলা-সংঘর্ষ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। এ সময় একটি পুলিশ বক্স ও রাস্তার পাশের অন্তত ৩০টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনার প্রতিবাদে ১২ মার্চ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা চারুকলা–সংলগ্ন রেললাইন ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ করে সড়ক অবরোধ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে তিনটি মামলা করে।

সংঘর্ষের দুই দিন পর ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য হুমায়ুন কবীরকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তবে দুই মাসের বেশি সময় পর রেজিস্ট্রার দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। পরে সেটি উপাচার্যের দপ্তরে হস্তান্তর করেন সাবেক রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম। কিন্তু প্রতিবেদন জমা হওয়ার ১০ মাস পেরোলেও সেটি আজও সিন্ডিকেটে উত্থাপিত হয়নি। জানা যায়নি প্রতিবেদনে কী আছে। ফলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।

সত্য ধামাচাপা ও আন্দোলন স্তিমিত করার জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করে। তারা কোনো রকম একটা দায়সারা রিপোর্ট জমা দেয়। সত্য উদ্‌ঘাটন ও তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, যাতে মানুষ সত্য ঘটনাটি জানতে পারে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে। এই জায়গায় প্রশাসনের নৈতিক দৃঢ়তার ঘাটতি আছে বলে মনে হয়। তবে এটি ঠিক নয়।’

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকিব বলেন, ‘এটিই একমাত্র ঘটনা নয়। এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলোর প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে যেকোনো দুর্ঘটনা বা কেলেঙ্কারি ঘটলেই দেখা যায় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আর সামনে আসে না।’

বিশিষ্ট নাট্যজন ও ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মলয় ভৌমিক বলেন, ‘যখন কোনো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সবার মধ্যে রাগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কারণ, এর ফলে বিষয়টি আপাতত থেমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে। এভাবে অসংখ্য তদন্তের প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না।’