ইলিশের মৌসুম শেষ হওয়ার পথে। অথচ দেশের নদ-নদীতে ইলিশ যেন একেবারেই অধরা। সাগরে অবশ্য কিছু ইলিশ মিলছে, তবে তা প্রত্যাশিত না হওয়ায় এবার শুরু থেকেই দাম ছিল আকাশচুম্বী। এরই মধ্যে ভারতে রপ্তানির খবরে ইলিশের দাম আরও বেড়েছে। তাই মধ্য ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে জাতীয় মাছ ইলিশ।
সংশ্লিষ্ট লোকজনের ভাষ্য, ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবর চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকারভেদে মণপ্রতি ৮ থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে। বাজারে ইলিশের দাম বেশি বলে সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তারা ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
এদিকে প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞার পরপরই শেষ হবে ইলিশের মৌসুম। তখন আবার জাটকা ধরার ওপর আট মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। বরিশাল, বরগুনার পাথরঘাটা ও পটুয়াখালীর বড় ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশের চড়া মূল্যের মধ্যে ভারতে রপ্তানির খবরে পাইকারি বাজারেই কেজিতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর মৎস্য বন্দরে আগে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৫২ থেকে ৫৫ হাজারে বিক্রি হতো। এখন তা বেড়ে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৮০০ গ্রামের নিচের ইলিশ আগে মণপ্রতি বিক্রি হতো ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখন তা ৫২ থেকে ৫৫ হাজারে বিক্রি হচ্ছে। আর ১ কেজির ওপরের ইলিশ মণপ্রতি প্রায় ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। স্থানীয় আড়তদার মজনু গাজী প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই ইলিশ এবার কম, তাই ব্যবসা লাটে ওঠার অবস্থা। তার ওপর রপ্তানির খবরে দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় পাইকারি বাজার আরও চড়া। প্রতিবছর রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হলেও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের কারণে আর্থিক সুবিধা পান না।
গতকাল রোববার বরিশাল নগরের পোর্ট রোডের ইলিশের পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, গত শনিবার ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের যে ইলিশের মণ ছিল ৬০ হাজার টাকা, তা ৬৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশের মণ আগের দিনের ৬৮ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৭৩ হাজার টাকা হয়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, বাজারে মাছের চাহিদা বেশি, কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ নেই। গতকাল এই পাইকারি বাজারে ৪০০ মণ ইলিশ এসেছে। এর মধ্যে ৩০০ মণই ছোট, যার ওজন ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম। বাকি প্রায় ১০০ মণ এর ওপরের বিভিন্ন ওজনের। ভারতে রপ্তানির জন্য ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে মজুত শুরু করায় হঠাৎ করে বাজারে চাহিদা বেড়েছে। এতে দামও কিছুটা বেড়েছে। রপ্তানি নিয়ে সিন্ডিকেটের বিষয়ে জহির সিকদার বলেন, ‘এটা আগেও ছিল। তবে এবার সবার জন্য উন্মুক্ত।’
দেশের অন্যতম বড় মৎস্যকেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটায় অবস্থিত। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন পরিচালিত এই অবতরণকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতে ইলিশ রপ্তানির খবরে এখানে পাইকারি বাজারে মাছের দাম বেড়েছে। সোমবার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ১ কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৭২ থেকে ৭৫ হাজার টাকা মণ দরে। ৭০০ থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৬৪ থেকে ৬৮ হাজার টাকা মণে। ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৫৪ থেকে ৫৬ হাজার টাকা। ৩০০ থেকে ৫৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৪৮ হাজার টাকা মণ দরে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাথরঘাটায় দুই দিনের ব্যবধানে প্রতি মণ ইলিশের দাম চার থেকে আট হাজার টাকা বেড়েছে। এটা আরও বাড়তে পারে। পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের বিপণন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এবার এমনিতেই ইলিশ আহরণ কম, এ জন্য দাম শুরু থেকেই অস্বাভাবিক। রপ্তানির কারণে ও চাহিদা বাড়ার কারণে দাম আরও বাড়তির দিকে।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের কথা শনিবার জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তারের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হয়।
তবে মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত রপ্তানি করা মাছের দাম নির্ধারণ করেনি। চিঠিতে বলা হয়েছে, কারা এসব ইলিশ রপ্তানি করতে পারবেন, তা কাগজপত্র দেখে ঠিক করা হবে।
২০১৯ সাল থেকে দুর্গাপূজার আগে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করে আসছে বাংলাদেশ। এবারও এই রপ্তানি নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে অনিশ্চয়তা ছিল। শুরুতে সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য ইলিশ রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত নিলেও শনিবার এ সিদ্ধান্ত বদলায়। ওই দিন ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ মাছ রপ্তানির সিদ্ধান্তের কথা জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী ৮ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া দুর্গাপূজার আগে বাংলাদেশের ইলিশ পাতে উঠবে ভারতীয়দের। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৯ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১ টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে।