যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ছাত্রীরা উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক নূর ইসলামের নেতৃত্বে গভীর রাতে ছাত্রীনিবাসের সামনে গিয়ে ছাত্রীদের নাম ধরে চিৎকার-চেঁচামেচি, ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার পথে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করেন নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া মাসখানেক আগে পরীক্ষা চলাকালে এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। বিভাগের শিক্ষকদের প্রতিরোধে ওই ছাত্রী রক্ষা পেলেও ভয়ে এখনো ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা নূর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে উত্ত্যক্ত করা হয় না। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতিতে বিভক্তি আছে। আসাদ হল ছাত্রলীগের কর্মীরা যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ আর মেয়েদের হলের কয়েকজন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এ জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবে তাঁরা এসব অভিযোগ করছেন।
উত্ত্যক্তের ঘটনায় প্রতিকার পেতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪ মার্চ কলেজের অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তারের কাছে একটি স্মারকলিপি দেন ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীরা। তবে তিনি সেটি গ্রহণ না করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উত্ত্যক্তকারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধ কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘ছাত্রীনিবাসের মেয়েদের স্মারকলিপি গ্রহণ করে পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন আর কেউ তাঁদের বিরক্ত করে না। ক্যাম্পাস এখন পুরোপুরি শান্ত। তা ছাড়া ২৬ হাজার শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাসে প্রতিদিন কত ধরনের ঝামেলা মোকাবিলা করতে হয়।’
শিক্ষার্থীদের দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, প্রতি রাতে ক্যাম্পাসের শহীদ আসাদ হলে (ছাত্রাবাস) থাকা অছাত্র ও বহিরাগত নূর ইসলামের নেতৃত্বে দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী শাহিন আলম, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের সাজু অন্তিমসহ কয়েকজন ছাত্রীনিবাসের পাশে গিয়ে মেয়েদের নাম ধরে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন, গালিগালাজ করেন। তাঁরা প্রতিদিন রাত ১১টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। প্রতিনিয়ত তাঁরা এমন উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছেন। তা ছাড়া আসাদ গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার সময় এবং ছাত্রীনিবাসের সামনের পুকুরপাড়ে বসেও তাঁরা উত্ত্যক্ত করেন বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়।
স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করা এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতি রাতে আসাদ হল থেকে ছাত্রলীগের নামধারী কয়েকজন বহিরাগত আমাদের নাম ধরে আজেবাজে কথা বলে। সারা রাত আমাদের উত্ত্যক্ত করে। আমরা রাতে পড়তে পারি না। ঘুমাতেও পারি না। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে কলেজের অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তারের কাছে একাধিকবার স্মারকলিপি দিয়েছি।’
ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীরা বলেন, তাঁরা স্মারকলিপি দিয়েছেন ১৪ মার্চ। অথচ যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই নূর ইসলামসহ কয়েকজনকে নিয়ে অধ্যক্ষ ১৭ মার্চ ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কেক কাটেন। তাহলে কীভাবে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন, প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।
অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘আমি কাউকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটিনি। নূর ইসলামও অন্যদের মতো কেক কাটার অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে পড়ে।’
গত ৩০ জানুয়ারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছিল। ওই দিন পরীক্ষার হল থেকে এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আসাদ হল ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ফারুক হোসেন বলেন, প্রথম বর্ষের ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘স্যার, আমাকে থানায় জিডি করার ব্যবস্থা করে দেন। বাইরে দেখেন, কয়েকজন ঘোরাঘুরি করছে। ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যেতে চায়।’ তিনিও দেখলেন, কয়েকটি ছেলে বিভাগের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছে। তাদের ডেকে ধমক দেন। কিন্তু তারা ওই ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যাবেই। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। শিক্ষকেরা মেয়েটিকে নিরাপদে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। এর মধ্যে মেয়েটির ভাই বিভাগের সামনে এলে তাঁকে মারধর করা হয়। অধ্যক্ষকে ফোন করার পর পুলিশ দিয়ে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
কলেজ থেকে শিক্ষার্থীকে অপহরণের মতো ফৌজদারি অপরাধে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, পুলিশের গাড়িতে ওই ছাত্রী ও তাঁর ভাইকে নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। পারিবারিকভাবে ওই ছাত্রীর সঙ্গে এক ছেলের বিয়ে ঠিক হয়। পরে ওই ছাত্রী আর তাকে বিয়ে করতে রাজি হননি। এ জন্য সেই ছেলে ওই ছাত্রীকে তুলে নিতে কলেজে আসে। এ ঘটনায় তাঁরা কী করতে পারেন?
ওই ঘটনার পর ভয়ে ওই ছাত্রী আর ক্যাম্পাসে ফেরেননি বলে জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষকেরা। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে তাঁর দ্বিতীয় বর্ষের পাঠদান শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে ওই ছাত্রীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ওই ছাত্রীর সহপাঠীরা বলেন, ছাত্রলীগ নেতা নূর ইসলামের প্রশ্রয়ে ওই ছাত্রীকে অপহরণ করতে গিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ক্যাম্পাসের সেই দিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা যাবে। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা নূর ইসলাম বলেন, ‘আমি ওই ছাত্রীকে চিনি না। তাঁকে তুলে নেওয়ার প্রশ্ন আসে না।’
নূর ইসলাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক। দুই বছর আগে তাঁর স্নাতকোত্তর শেষ হয়। ছাত্রত্ব না থাকলেও থাকেন শহীদ আসাদ হলের ২০৬ নম্বর কক্ষে। শুধু নিজেই থাকেন না; তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে গোটা আসাদ হল ও কলেজ ক্যাম্পাস।
হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৮০ জন ধারণক্ষমতার তিনতলা হলে বর্তমানে থাকেন ৬০ জন। এর মধ্যে কলেজের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৫ জনকে। বাকি ২৫ জনের মধ্যে অন্য কলেজের শিক্ষার্থী আছেন ১০ জনের মতো। তৃতীয় তলার ৩০৪ নম্বর কক্ষে থাকেন আবদুর রাজ্জাক মিউনিসিপ্যাল কলেজের এক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া সরকারি সিটি কলেজের শিক্ষার্থী আছেন কয়েকজন। তাঁদের কাছ থেকে প্রতি মাসে আসনভাড়া বাবদ ৪০০ টাকা করে নেন নূর ইসলাম।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নূর ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে আমি আসাদ হল দেখভালের দায়িত্বে আছি। ছাত্রলীগের কমিটির কেউ হলে থাকেন না। তবে ১৫ থেকে ২০ জন সক্রিয় কর্মী আছেন। তাঁরা ছাত্রলীগের সভা-সমাবেশে যান। কারও কাছ থেকে মাসিক কোনো টাকা তোলা হয় না।’ ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও হলে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মাস্টার্স শেষ করেছি। আবার অন্য বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হব।’