প্রায় এক বছর ধরে চলছে মেহমানদারি। মেহামানখানায় অতিথি অসহায়-ছিন্নমূল মানুষ। যাঁদের খোঁজ কেউ রাখেন না, তাঁদের এক বেলা পেটপুরে খাওয়াতেই এই আয়োজন একদল যুবকের। অসহায় মানুষদের আপ্যায়নে সপ্তাহের শুক্রবারকে বেছে নিয়েছেন তাঁরা। ব্যতিক্রমী এই আয়োজন চোখে পড়ে নড়াইল পৌর শহরের পুরাতন বাস টার্মিনাল–সংলগ্ন হাসিব প্লাজার সামনে। হাসিব প্লাজার কয়েকটি দোকানের মালিক ও তাঁদের বন্ধুরা মিলে করেন এই আয়োজন।
আয়োজকরা বলেন, গত ৩৯ সপ্তাহ ধরে মেহমানদারি করছেন তাঁরা। তাঁদের অতিথির শহরের ভিক্ষুকসহ বিভিন্ন পেশার দরিদ্র মানুষ। প্রথম দিকে মেহমানের সংখ্যা ছিল ২০-৩০ জন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ জন। মেহমানখানায় প্রতি শুক্রবার ভিন্ন ভিন্ন খাবারের আয়োজন করা হয়। পোলাও, বিরিয়ানি ও সাদা ভাতের সঙ্গে মাংস; আবার কোনোদিন রান্না হয় খিচুড়ি–মাংস।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, হাসিব প্লাজার নিচে সরদার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে সকাল থেকে মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যস্ততা চলছে। বাজার করে আনার পর সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছেন দুই যুবক। তারপর তিনটি বড় বড় হাঁড়িতে শুরু হয় রান্নার কাজ। রান্না করছেন কামরুল মোল্যা নামের এক ইজিবাইক চালক। তাঁর বাড়ি সদর উপজেলার রঘুনাথপুরে। নড়াইল শহরে ইজিবাইক চালান। প্রতি শুক্রবারে এখানে এসে বিনা পারিশ্রমিকে রান্না করে দেন তিনি।
কাজের ফাঁকে কথা হয় কামরুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে অসহায় মানুষদের বিনা মূল্যে খাবার খাওয়ানো হয়। আমি এসে ভাইদের (আয়োজক) সঙ্গে রান্নাবান্নার কাজে সহযোগিতা করি। ভালো কাজে শ্রম দিতে ভালো লাগে, তাই গাড়ি চালানো বাদ দিয়ে এখানে আসি। প্রতি শুক্রবার আলাদা আলাদা ধরনের খাবার রান্না করা হয়।’
শুক্রবার জুমার নামাজ শেষ হতে না হতেই মেহমানখানায় একে একে ভিড় জমাতে থাকেন শহরের দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষেরা। মাদুর পেতে সেখানে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েন তাঁরা। তাঁদের কাছে খাবার ও পানি নিয়ে পৌঁছে দেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। মেহমানদের মতোই আপ্যায়ন করা হয় তাদের। সবাই পেটপুরে খাবার খেতে পারেন।
সদর উপজেলার বাঁশগ্রামের বাসিন্দা শেখ শাকিবুর রহমান (৬০) চোখে দেখতে পান না, কানেও কম শোনেন। শহরে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে কোনোমতে চলে তাঁর সংসার। বাড়িতে ভালো খাবার জোটে না। তাই ছোট দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে একবেলা ভালো খেতে এখানে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে আসি খাবারের জন্য, তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারি।’
ভ্যানচালক রকি মোল্যা বলেন, ‘এখানে গোশত, বিরিয়ানি, পোলাও খেতে দেয়। আমাদের মতো গরিব মানুষেরা সচরাচর এত ভালো খাবার খেতে পায় না।’
লাইলি বেগম নামের এক ভিক্ষুক নারী বলেন, ‘আমাদের ভালো ভালো খাবার খেতে দেয়। যত্নে কোনো ত্রুটি করে না। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাঁদের খাওয়ানোর তৌফিক দান করে, আমরা খেতে পারি।’
আয়োজকদের একজন নাজমুল ইসলাম জুয়েল। তিনি ব্যবসায়ী। তাঁর দোকানের সামনেই মেহমানদারির আয়োজন করা হয়। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের চারপাশে অনেক গরিব, অসহায় ও এতিম মানুষ আমরা দেখতে পাই। যাদের দুই ঈদ ছাড়া মাংস খাওয়া জোটে না। তাঁদের কেউ দাওয়াত করে খাওয়ায় না। এই চিন্তাভাবনা করে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিই মানুষকে সপ্তাহে একবেলা খাওয়ানোর। নিজেরা অর্থ দিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করে প্রায় এক বছর ধরে এই কার্যক্রম চালাচ্ছি।’ পরে সপ্তাহে একদিন তিন বেলা খাওয়ানোর ভাবনা আছে তাদের।