অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক অর্পিতা বিশ্বাস
অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক অর্পিতা বিশ্বাস

সাফজয়ী অধিনায়ক অর্পিতার বাড়ির অবস্থা কেমন, কীভাবে চলে পরিবার

সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক অর্পিতা বিশ্বাসের (১৬) বাড়ি মাগুরার শ্রীপুরের গোয়ালদহ গ্রামে। মাটির মেঝে আর টিনের চালার ছোট দুটি কক্ষের ঘর তাদের। ঘরে আসবাব বলতে দুটি খাট।

জেলা শহর থেকে এই অর্পিতাদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। এই গ্রামেরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট একটি মাঠে ফুটবল খেলা শুরু অর্পিতার। এরপর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) হয়ে সে এখন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক। বিকেএসপির দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্পিতা এখন ফুটবল দিয়েই নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন।

দাদি মারা যাওয়ার খবরে গত শনিবার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসে অর্পিতা বিশ্বাস। রোববার তার সঙ্গে কথা হয়। গোয়ালদহ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই স্থানীয় ব্যক্তিরা দেখিয়ে দেন অর্পিতাদের বাড়ির পথ। বাসস্ট্যান্ড থেকে আনুমানিক দুই শ মিটার দূরে পাকা রাস্তার পাশে অর্পিতাদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে কথা হয় অর্পিতার বাবা মনোরঞ্জন বিশ্বাসের (৫২) সঙ্গে। প্রায় দুই দশক আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় বাঁ পায়ে আঘাত পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দিন পার করছেন। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে গ্রামের বাজারে সবজি বিক্রি করেন তিনি।

মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ৬ শতাংশ জায়গায় তাঁদের চার ভাইয়ের বসবাস। ভাগ করলে একেক ভাইয়ের অংশে পড়ে দেড় শতাংশ জমি। মাঝে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে ঘর তুলেছেন সবাই। সেখানে ছোট দুই কক্ষের টিনের ঘরে স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে থাকেন মনোরঞ্জন। মাঠে কোনো জমি নেই। ভিটেমাটি বলতে এটুকুই। অর্পিতা যখন বাড়িতে আসে, তখন ওরা দুই ভাই-বোন দুই কক্ষে ঘুমায়। এ সময় অর্পিতার বাবা ও মাকে ঘুমাতে হয় বাড়ির বারান্দায় পাটি পেতে। মনোরঞ্জন বলেন, ‘যেমনই থাকি দুঃখ নেই। নিজে পড়ালেখা করতে পারিনি। ছেলেটাও ভালো কিছু করতে পারল না। এখন আমার সব স্বপ্নই মেয়েকে ঘিরে।’  

অর্পিতার মা গায়ত্রী বিশ্বাস এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। স্বামীর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ৫ বছর আগে সংসারের খরচ মেটাতে তিনি এই চাকরি নেন। অর্পিতার বড় ভাই কিশোর বিশ্বাস মাধ্যমিকে ফেল করে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে ইজিবাইক চালান। গায়ত্রী বিশ্বাস বলেন, অর্পিতার বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে তাঁদের পরিবারের হিমশিম খেতে হয়েছে। কখনো কখনো অর্পিতার খরচ পাঠাতে তাঁদের অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হয়েছে।

গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবার থেকে অর্পিতার ফুটবলার হয়ে ওঠার পথটা সহজ ছিল না। অর্পিতা বলে, শুরুতে পরিবার থেকে তাকে ফুটবল খেলতে বাধা দেওয়া হতো। সে সময় অনেকটা জোর করেই ফুটবল খেলা শুরু করে সে। এখন অবশ্য বাবা-মা থেকে শুরু করে এলাকার সবাই তাকে নিয়ে গর্বিত। অর্পিতা বলল, ‘বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন ছিল। তবে কখনো ভাবতে পারিনি অধিনায়কের দায়িত্ব পাব। দেশের জন্য আরও ভালো কিছু করতে চাই। আর যেহেতু বিকেএসপিতে পড়ছি, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করব। এভাবে যদি ঠিকমতো খেলতে ও পড়তে পারি, তাহলে একটা ভালো চাকরি পাব বলে আশা করি।’

অর্পিতাদের ফুটবল খেলা নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলে থাকা সাথী বিশ্বাস ও ইতি রানী মন্ডলের বাড়িও এই গোয়ালদহে। তাঁরাও এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামের ওই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট মাঠে দুজন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে অর্পিতা, সাথী, ইতিসহ প্রায় ২০টি মেয়ে এখন বিকেএসপি ও বিভিন্ন জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে খেলছে।

অর্পিতা বিশ্বাসের প্রথম কোচ গোয়ালদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্পিতা খুবই ভালো মানের খেলোয়াড় ও ভালো শিক্ষার্থী। ও যেখানেই খেলেছে, সেরা খেলোয়াড় হয়েছে। কিন্তু ও খুবই দরিদ্র একটা পরিবারে বেড়ে উঠেছে। ওদের থাকার মতো ভালো একটা বাড়িও নেই।’ তিনি অর্পিতাদের একটি বাড়ি করে দিতে সরকারের ও সমাজের বিত্তবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এই শিক্ষক বলেন, ২০১৪ সালে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণ শুরু করেন তাঁরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাস রঞ্জন দেবজ্যোতি ও সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলামের উদ্যোগে স্কুলের ছোট মাঠে প্রতিদিন সকাল-বিকেল নিয়ম করে মেয়েদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতেই আসছে একের পর এক সফলতা।