উম্মে হানি সুলতানা, মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি।
উম্মে হানি সুলতানা, মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামের বাসিন্দা তিনি।

মাগুরার উম্মে হানির উদ্যোক্তা হওয়ার অদম্য লড়াই

পঞ্চম শ্রেণি পাসের পরপরই বিয়ে হয়ে যায় উম্মে হানি সুলতানা শম্পার। কিশোরী বয়সেই সংসার নামের বড় দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। ফলে আর পার হতে পারেননি মাধ্যমিকের গণ্ডি। এরপরও নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী হয়েছেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার জাঙ্গালিয়া গ্রামের বাসিন্দা এই নারী। তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। অসুস্থ স্বামী, দুই সন্তান আর সংসারের দেখভাল করছে একাই। উদ্যোক্তা হিসেবে উম্মে হানির নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বড় অবদান ছিল ইন্টারনেটের।

উম্মে হানির ছেলে এখন পড়ছে নবম শ্রেণিতে, মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। অনেক বছর থেকেই নিজে কিছু একটা করার আগ্রহ ছিল তাঁর। কিন্তু তখন স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তাই সংসারের খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। ১১ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়ার পর উপার্জনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন স্বামী। এরপর সংসারের হাল ধরতে হয় উম্মে হানিকে। নানা রকম চেষ্টা করেছেন। সফল হননি। ২০২০ সালে করোনা মহামারির শুরুতে মহম্মদপুর উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে সেলাইকাজের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে বিনা মূল্যে পাওয়া ছয় হাজার টাকার কাপড় দিয়ে শুরু হয় উম্মে হানির উদ্যোক্তা হওয়ার অদম্য লড়াই।

নিজের ছোট্ট ঘরই তখন হয়ে ওঠে উম্মে হানির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নিজ হাতে তৈরি পোশাক ও কুটিরশিল্পের পণ্য স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বিক্রি করা শুরু করেন। প্রথম দিকে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থাকলেও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পণ্যের প্রচার চালাতেন না তিনি। ফলে ব্যবসার প্রসারও তেমন হচ্ছিল না। দুই বছর আগে উম্মে হানির স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন স্বামীর চিকিৎসায় ব্যবসার সব টাকাই খরচ হয়ে যায়। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় উম্মে হানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম।

তবে হার মানেননি এই নারী। আবারও কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় মহিলা অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী রান্নার প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে শুরু হয় উম্মে হানির নতুন উদ্যোগের যাত্রা। কেক, পিৎজা ও নানা রকম পিঠার পাশাপাশি দেশি মুরগি, হাঁস, ভাত-বিরিয়ানিসহ ঘরোয়া খাবার বিক্রি শুরু করেন তিনি। আর প্রচারের জন্য এবার বেছে নেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক ও ইউটিউবকে।

খাবারের এই ব্যবসা থেকে এখন প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা আয় হয় উম্মে হানির।

গত ২৫ নভেম্বর দুপুরে উম্মে হানির বাড়ি গিয়ে দেখা যায় তিনি রান্নায় ব্যস্ত। পরিবারের সদস্যরা তাঁকে সহযোগিতা করছেন। উম্মে হানি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি আগ্রহ ছিল। সবাই বলত আমি রান্নায় ভালো করতে পারব। এ কারণে রান্নার ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তবে ইন্টারনেট থেকেই আমি বেশি শিখেছি। যেকোনো খাবার বিষয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলো দেখে খুঁটিনাটি অনেক কিছু শিখি। কোনো বিষয়ে না জানা থাকলে সার্চ দিই। সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান পাওয়া যায়।’

স্থানীয় উপজেলার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে সরবরাহ করা হয় উম্মে হানির রান্না করা খাবার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যও নানা রকম খাবারের অর্ডার আসে তাঁর কাছে। যার একটি বড় অংশ আসে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, উপজেলার বাইরে থেকেও কেক ও পিৎজার অর্ডার পান তিনি। উম্মে হানি বলেন, ‘শুরুর দিকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ভিডিও করতাম না। কিন্তু আমাদের মতো উদ্যোক্তাদের অনলাইনে প্রচারের বিকল্প নেই। রান্নাসহ বিভিন্ন ধরনের ভিডিও করে এখন ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে দিই। এতে ব্যবসার প্রচার-প্রসার ভালো হচ্ছে।’ এই নারী উদ্যোক্তা জানান, খাবারের এই ব্যবসা থেকে এখন প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। যা দিয়ে অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা, ছেলেমেয়ের পড়ালেখাসহ সংসারের অন্য খরচ চলে। ক্রমেই আত্মবিশ্বাস বাড়ছে তাঁর। আর এ কাজে এখন সবার সহযোগিতাও পাচ্ছেন।

উম্মে হানির মতো অসংখ্য গ্রামীণ নারী ইন্টারনেট-সুবিধার কারণে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাহস পাচ্ছেন। সফলও হচ্ছেন অনেকেই। উম্মে হানি বলেন, ‘তৈরি পোশাক ও হাতের কাজের ব্যবসা আপাতত বন্ধ রাখলেও হাল ছাড়িনি। সামনে আবারও এই ব্যবসা চালু করতে চাই। অনলাইনেই প্রচার করব। এ ছাড়া ফেসবুক ও ইউটিউবে নিয়মিত ভিডিও প্রচার করছি। আশা করছি, ভবিষ্যতে ওখান থেকেও ভালো আয় করতে পারব।’

উম্মে হানি এখন নিজের এবং আশপাশের গ্রামের নারীদের অনুপ্রেরণা। তাঁরাও চান উম্মে হানির মতো সফল উদ্যোক্তা হতে। এ রকম অসংখ্য নারীকে ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে আয়োজিত উঠান বৈঠক কার্যক্রমের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গত মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ২ হাজার ২৭টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।