কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য, পিআইও, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের গোড়াই পাঁচপীর মিয়াজিপাড়া কবরস্থান সংস্কারের জন্য সরকারি বরাদ্দ দেখানো হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে গোড়াই পাঁচপীর মিয়াজিপাড়া মসজিদ কমিটির হিসাবরক্ষক আবদুর রহিম বলেন, ‘কবরস্থান সংস্কারের কোনো বাজেট আমরা পাইনি। গত এক বছরে কবরস্থানের কোনো সংস্কারকাজও হয়নি।’
উলিপুর উপজেলা ঘুরে এই প্রকল্পের মতো এমন কিছু প্রকল্প পাওয়া গেছে, যেগুলোর কাজ কাগজে-কলমে সমাপ্ত। গত জুন মাসের মধ্যে এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দের টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে এসব প্রকল্পের কোনো কাজই শুরু হয়নি।
এ উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর), কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) ও কাজের বিনিময় খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির অধীনে নানা প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে এসব প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে স্থানীয় লোকজনের দাবি, এসব প্রকল্পের কোথাও নামেমাত্র কাজ হয়েছে, কোথাও কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার কিছু প্রকল্প শুধু কাগজে–কলমে আছে, বাস্তবে কাজের কোনো অস্তিত্ব নেই।
টিআর-কাবিখা প্রকল্প মানেই লুটপাটের কারবার। টাকা কত বরাদ্দ আসে, কে কাজ করে, আমরা খবর পাই না। গত দুই বছরে ইউনিয়নের কোনো রাস্তার কাজ কিংবা মসজিদ-মাদ্রাসার কাজ টিআর-কাবিখা প্রকল্পের টাকায় হয়নি। বাবলু মিয়া, ইউপিচেয়ারম্যান, বেগমগঞ্জ, উলিপুর
উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় (পিআইও) সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে টিআরের ১৯০টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ হয়েছে ৩ কোটি ৬ লাখ ৭৬ হাজার ২১৮ টাকা। এ ছাড়া কাবিটার ৩৩টি প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৯ হাজার ১৬৮ টাকা, কাবিখার ৩৪টি প্রকল্পে ৩৬০ দশমিক ৯৮৯ মেট্রিক টন চাল এবং ২৫টি প্রকল্পে ২৯১ দশমিক ৯৮৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ হয়েছে।
জানতে চাইলে উলিপুরের পিআইও সিরাজুদ্দৌলা বলেন, জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাই প্রতিটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন দেখিয়ে চেক ইস্যু করে টাকা তুলে রাখা হয়েছে। এখন যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, সেই প্রকল্পের চেক প্রদান করা হবে। এখানে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সত্য নয়। কাজের ধীরগতির বিষয়ে তিনি বলেন, কুড়িগ্রাম জেলা বন্যাপ্রবণ হওয়ায় জুন-জুলাই মাসের দিকে রাস্তা সংস্কার বা মাঠ ভরাটের কোনো মাটি পাওয়া যায় না। এ জন্য অধিকাংশ কাজ শেষ করা যায়নি।
কাগজপত্র বলছে, উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের ফকির মোহাম্মদ কবরস্থানের মাটি ভরাটের জন্য তিন লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে কবরস্থান কমিটির সভাপতি হযরত আলী এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘কবরস্থানের মাটি ভরাটের জন্য আমরা কোনো বরাদ্দ পাইনি। আপনারা সরেজমিনে এসে দেখে যান এখানে কোনো কাজ হয়নি। সরকার থেকে টাকা এলে কম হোক, বেশি হোক—কাজ হতো। আপনারা তদন্ত করে বের করেন, মাটি ভরাটের টাকা কে খাইল?’
বুড়াবুড়ী ইউনিয়নের ইসলাম বাজার থেকে সরকার বাজার পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের কাজের জন্য চার লাখ টাকা, ফকির মোহাম্মদ কবরস্থানের মাটি ভরাটের জন্য তিন লাখ টাকা, ফকির মোহাম্মদ মণ্ডলপাড়া জামে মসজিদের মাঠ ভরাটের জন্য তিন লাখ টাকা, কামারপাড়া ওয়াক্তি মসজিদ সংস্কারের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোনো কাজ করা হয়নি। অথচ এসব প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে জুনেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, কুড়িগ্রাম–৩ আসনের সংসদ সদস্য, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি অন্তত চারজন ইউপি সদস্য স্বীকার করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দের টাকার একটি অংশ চেয়ারম্যান, সরকারদলীয় লোকজনকে দিতে হয়। আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়, উপজেলা পরিষদেও টাকা দিতে হয়। এসব টাকা ভাগের পর যতটুকু টাকা থাকে, সেটা দিয়ে সামান্য কাজ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। এরপরও কাজের অনিয়মের সব দোষ তাঁদের (ইউপি সদস্য) ওপরই পড়ে।
অভিযোগের বিষয়ে বেগমগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, ‘টিআর–কাবিখা প্রকল্প মানেই লুটপাটের কারবার। টাকা কত বরাদ্দ আসে, কে কাজ করে, আমরা খবর পাই না।
২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের টাকার কিছুই পাইনি। আগের চেয়ারম্যান টাকা পেয়েছেন কি না, সেটাও জানি না। তবে গত দুই বছরে ইউনিয়নের কোনো রাস্তার কাজ কিংবা মসজিদ–মাদ্রাসার কাজ টিআর–কাবিখা প্রকল্পের টাকায় হয়নি।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম–৩ আসনের সংসদ সদস্য এম এ মতিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি শুধু কাজের বরাদ্দ দিয়ে থাকি, দেখভাল করার জন্য সুপারভিশন কমিটি থাকে, তারাই কাজের তদারকি করে। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখব।’