বই পড়তে কোথায় যান চট্টগ্রামের মানুষ

চট করে সমুদ্র দেখতে হলে মাত্র ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে চট্টগ্রামের নগরবাসী এখন চলে যান পতেঙ্গা। হাওয়া খেতে যান সিআরবি। কাপড় কিনতে টেরিবাজার। আর খেতে হলে নগরজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। কিন্তু বই পড়তে? বই পড়ার ইচ্ছা হলে কোথায় যান চট্টগ্রাম নগরের মানুষ? কোথায় পাওয়া যায় একটু ভালো আলো, নিরিবিলি চেয়ার-টেবিল আর ডুব দেওয়ার মতো উৎকৃষ্ট দেশি-বিদেশি বইয়ের সংগ্রহ! অবাক বিষয় হচ্ছে বিশাল এই বন্দর নগরে বর্তমানে নেই কোনো গণগ্রন্থাগার। সিটি করপোরেশনের একটি গ্রন্থাগারই সব নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত আছে। তবে সেটির পরিসর ছোট, পড়ার সময়কাল ও সংক্ষিপ্ত।

চট্টগ্রাম নগরের একমাত্র বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারটি চার বছর ধরে বন্ধ সংস্কার কাজের জন্য। গত বছরই কাজ শেষ করে পাঠকদের জন্য গ্রন্থাগারটি চালু করার কথা ছিল। নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হল ও বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করা হলেও পাঠাগারের কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। ফলে সেখানে এখনো বই পড়া যাচ্ছে না।

বর্তমানে নগরের প্রায় ৬০ লাখ বাসিন্দার জন্য লালদীঘির পশ্চিম পাড়ের সিটি করপোরেশনের গণপাঠাগার ছাড়া আর কোনো উন্মুক্ত বই পড়ার জায়গা নেই। ১২০ বছর বয়সী এ পাঠাগারটিই বর্তমানে নগরের লেখক, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ বই পড়ুয়া সাধারণ মানুষের একমাত্র আশ্রয়। প্রায় ৪৫ হাজার বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে পাঠাগারটিতে। শুক্রবার-শনিবার বাদে সপ্তাহে পাঁচ দিন বেলা ১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে পাঠাগারটি।

সিটি করপোরেশনের পাঠাগারে প্রায়ই বই পড়তে যান সাহিত্যিক সৈকত দে। তিনি জানান, ‘নগরের একমাত্র এই পাঠাগারটি ছাড়া বই পড়ার আর জায়গা নেই। এখানেও নতুন বইপত্র তেমন পাওয়া যায় না। বই পড়তে বসে লোডশেডিং এ ভুগতে হয়। লেখালেখির কাজে প্রায়ই নানা বইপত্র ঘাঁটতে হয়। ভালো পাঠাগারের অভাবে দরকারি বই কিনে বা সংগ্রহ করে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না।’

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরি ঘুরে দেখা গেল ভেতরে বসে কয়েকজন পাঠক বই পড়ছেন। বেশির ভাগই মূলত পড়ছেন পত্রিকা, সাময়িকী বা চাকরির পরীক্ষার বইপত্র। ভেতরের শেলফে থরে থরে সাজানো রয়েছে অসংখ্য বই। প্রেমেন্দ্র মিত্র, আবুল ফজল, বন্দে আলী মিয়াসহ নামকরা লেখকদের বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে পাঠাগারটিতে। রয়েছে শেক্‌সপিয়ার, রুডইয়ার্ড কিপলিং, ভলতেয়ার, জর্জ অরওয়েলসহ বিশ্বসাহিত্যের নামী লেখকদের বই।। এ ছাড়া ছহি বড় জঙ্গনামা, জৈগুনের পুথি, ছয়ফুল মুলুক, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্য, বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য থেকে শুরু করে প্রাচীন পুথি সাহিত্য, কাব্য সাহিত্য, এনসাইক্লোপিডিয়া, উপন্যাস, ইংরেজি সাহিত্যের কালজয়ী সব সংস্করণও আছে এখানে।

তবে অধিকাংশ বইয়ের অবস্থা জরাজীর্ণ। নতুন ঝকঝকে পাঠাগার ভবনে জরাজীর্ণ মূল্যবান বইপত্রে ঠাসা পাঠাগারটি অনেকটা নগরবাসীর চোখের আড়ালেই পার করে ফেলেছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়।

সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক কৃষ্ণ কমল সেন জানালেন, করোনার বন্ধের পর নতুন ভবনে পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু হয়। নিয়মিত ২৪টি দৈনিক পত্রিকা আসে পাঠাগারে। আরও বিভিন্ন সাময়িকী আসে। এগুলোই বেশি পড়েন পাঠকেরা। তবে বই কেনার জন্য নিয়মিত কোনো বরাদ্দ নেই। বর্তমানে আগের মতো তেমন পাঠক আসেন না। মূলত রেফারেন্স লাইব্রেরি হিসেবেই এই পাঠাগারের ব্যবহার বেশি।

এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত সূর্যসেন পাঠাগারের সদস্য সংখ্যা ১০২ জন। নগরের সিডিএ অ্যাভিনিউ এর মসজিদ গলিতে অবস্থিত এ পাঠাগারে বই রয়েছে ১ হাজার ৫০০ টি। পাথরঘাটার মহিমদাস রোডের ক্ষুদিরাম পাঠাগার, চট্টগ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র, জামালখানের কাজী নজরুল পাঠাগারসহ ছোটখাটো আরও বেশ কয়েকটি পাঠাগার রয়েছে নগরজুড়ে। তবে এগুলো সবই বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা। সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। একটি নগরীর গণপাঠাগারের অভাব তাতে পূরণ হয় না।

বলা হয়, প্রতি বর্গকিলোমিটারের মধ্যে একটি গণপাঠাগার থাকা আবশ্যক। সেই হিসেবে কম করে হলেও এই দেশে ৫০ হাজার গণপাঠাগার থাকার কথা। কিন্তু সারা দেশে সরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যাও এক শর বেশি নয়। বেসরকারি উদ্যোগেও চট্টগ্রামে সবার জন্য উন্মুক্ত গণপাঠাগার গড়ে ওঠেনি।

নগরের প্রবীণ সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন চট্টগ্রামের পাঠাগার নিয়ে নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করলেন। তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমরা যখন পড়তাম তখন মিউনিসিপ্যালটির (সিটি করপোরেশন) পাঠাগার, বিভাগীয় পাঠাগার, ব্রিটিশ কাউন্সিল, রেলওয়ে পাবলিক লাইব্রেরিসহ বেশ কয়েকটি গণপাঠাগার ছিল নগরে। দিনদিন মানুষ বেড়েছে কিন্তু গণপাঠাগার বাড়েনি। বরং কমেছে। এত দিন ধরে বিভাগীয় গণপাঠাগারটি বন্ধ কিন্তু নগরে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই তা নিয়ে। সাধারণ মানুষ ছাড়াও লেখক ও গবেষকদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বইপত্র দরকার হয়। কত আর কেনা সম্ভব? শহরে গণপাঠাগার থাকা সবার জন্যই খুব জরুরি। আরও জরুরি সেগুলোর সঠিক পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ।