টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় ফসলি জমি থেকে অবৈধভাবে মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি পরিবহনের জন্য খালে বাঁধও দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা অভিযোগ করে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক এক সদস্যের নেতৃত্বে এসব মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। মাটি কাটার প্রতিবাদ করলে তাঁর অনুসারীরা এলাকার লোকজনকে মারধর ও বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
উপজেলার বানাইল ইউনিয়নের নরদানা গ্রামে এ ঘটনা ঘটছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। সেই মাটি কাটা হলে জমির জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফসলি জমির মাটি কাটা তাই বেআইনি।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, নরদানা গ্রামে থাকা খালের মাধ্যমে পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে লৌহজং নদের সংযোগস্থলে পানি পড়ছে। খালের প্রায় শেষ মাথায় প্রায় ১৫ ফুট উঁচু করে মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। খালটির পূর্ব পাশ থেকে পশ্চিম পাশে পানির উচ্চতা বেশি। বাঁধের পাশেই রাখা হয়েছে এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র)। বাঁধের দিয়ে মাটি আনা-নেওয়া করা হয় ট্রাক্টর দিয়ে। খালের একদম পাশে থাকা বিভিন্ন ফসলি জমিতে গভীর গর্ত করে মাটি কাটা হয়েছে।
এ সময় একজন ট্রাক্টরচালককে মাটি নিয়ে যেতে দেখা যায়। তাঁর নাম জিন্নত মিয়া। তিনি বলেন, তাঁরা দিনে মাটি আনা-নেওয়া করেন। এ জন্য ট্রাক্টরের মালিক তাঁকে দিনে ৬০০ টাকা মজুরি দেন। আর রাতে ট্রাকযোগে মাটি অন্যত্র নেওয়া হয়।
গ্রামবাসী বলেন, প্রায় ৪০ ফুট প্রশস্তের ওই খাল ২০০ বছরের বেশি পুরোনো। প্রায় ৪০ বছর আগে খালটি খনন করা হয়েছিল। খালটির কারণে পার্শ্ববর্তী পাটুলি, বানাইল, বাংগল্যা, কালা ভাতগ্রাম ও টেগুরী এলাকার জমিতে ফসল হয়। বাঁধের কারণে এ বছর শর্ষে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
নরদানা গ্রামের মোহাম্মদ জিন্নাহ ব্যবসায়ীদের কাছে মাটি বিক্রি করেছেন। পাশাপাশি তিনি মাটির ব্যবসাও করেন। তিনি বলেন, তাঁর জমিতে শর্ষে বুনেছিলেন। ভালো উৎপাদন হবে না শঙ্কায় তিনিসহ কয়েকজন তাঁদের জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন। সেগুলোই কাটা হচ্ছে।
এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার জামুর্কী ইউপির সাবেক সদস্য আগধল্যা গ্রামের বাসিন্দা সাদেক হোসেন, বরাটি গ্রামের তুষার বিশ্বাস, নরদানা গ্রামের মোহাম্মদ জিন্নাহ, ভাষানী মিয়া, রুবেল মিয়াসহ কয়েকজন মিলে এ বাঁধ দিয়ে মাটি কাটছেন। তাঁরা নরদানা গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবহমান খালের ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেন। ১২ দিন আগে তাঁরা ডাম্পট্রাকযোগে (বড় আকারের ট্রাক) খালের উত্তর পাড়ের ফসলি জমি থেকে এক্সকাভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে মাটি কেটে এনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি শুরু করেন। প্রশাসনের ঝামেলা এড়াতে তাঁরা প্রতিদিন রাত সাড়ে আটটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত মাটি কাটার কাজ করছেন। আর দিনে ট্রাক্টরযোগে মাটি আনা-নেওয়া করা হয়। গ্রামের ভেতর দিয়ে মাটিবোঝাই ট্রাক চলাচল করায় রাস্তার ক্ষতি হচ্ছে। রাতে শব্দে তাঁরা ঘুমাতে পারেন না।
গ্রামবাসী আরও বলেন, মাটি কাটার প্রতিবাদ করলে ওই চক্রের লোকজন তাঁদের মারধর করেছেন। কয়েকজনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। ব্যবসায়ী তুষার বিশ্বাস এসব করছেন। আর তাঁদের সঙ্গে আছেন ইউপির সাবেক সদস্য সাদেক হোসেন।
ব্যবসায়ী তুষার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গ্রামের লোকজনকে মারধর করা ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ধল্যার সাদেক মেম্বার, নরদানার ভাষানীসহ ১৭ জন পার্টনার আছে। ২৫০ টাকা গাড়ি মাটি কিনি। কোনো ব্যবসা নেই। আমার বাসায় আমিই ফালাই। রাত কইরা গাড়ি চালাইলে কেউ কিছু বলে না।’
ভয় দেখানোর বিষয়ে তুষার বলেন, ‘হ্যায় ভয় দ্যাহাই। হ্যাই চান্দামান্দা চায়। গাড়ি চলে দেইখ্যা রাজীব (নরদানা গ্রামের বাসিন্দা) চান্দা চায়।’
অভিযোগের বিষয়ে ইউপির সাবেক সদস্য সাদেক হোসেন জানান, তিনি মাটির ব্যবসায় জড়িত নন। তবে মাটি কাটার যন্ত্র ও ট্রাকে তিনি তেল সরবরাহ করেন। এতে তাঁর কিছুটা লাভ হয়। তিনি আরও বলেন, ‘পুলাপানে কাটতাছে। তিন পার্টি মাটি কাটতাছে। তুষাররে (ব্যবসায়ী তুষার বিশ্বাস) আমরা শেল্টার দিই। ওগো গাড়ি আছে। আমরা কইছি কাটগা। ওন থিক্যা (নরদানা গ্রাম) তাফালিং (বাঁধা) আহে। আমরা ফিরাই।’
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) আইন অনুযায়ী, ফসলি জমি বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হওয়ায় আশঙ্কা থাকলে, সেখান থেকে বালু বা মাটি তোলা যাবে না। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুদুর রহমান বলেন, খালে কোনোভাবেই বাঁধ দেওয়া যাবে না। অবৈধ মাটি কাটার বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।