কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জোটসঙ্গী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের টানাপোড়েন কোনোভাবেই কমছে না। বছরখানেক আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পর দুই দলের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। নতুন করে পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির মাঠে।
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে মাঠে কাজ করা অবস্থায় ভেড়ামারা উপজেলার চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম ওরফে স্বপন, তাঁর ভাই চাঁদগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান যুবজোটের নেতা আবদুল হাফিজ ওরফে তপনসহ জাসদের নেতা-কর্মীদের নামে হত্যা মামলা করেন সিদ্দিকুরের পরিবারের লোকজন।
এ হত্যাকাণ্ডের পর জাসদ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরে। এক দল অন্য দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে মিছিল সমাবেশ করে। হত্যাকাণ্ডের জের ধরে আওয়ামী লীগের লোকজন জাসদ নেতা ও তাঁদের সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে চলেও যান। জাসদ নেতারা বলছেন, ওই ঘটনার পর জাসদের অন্তত ৮০টি পরিবারে হামলা চালিয়ে তাঁদের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়।
এদিকে জাসদের সহযোগী সংগঠন জাতীয় যুবজোটের নেতা-কর্মীদের হামলায় আহত ভেড়ামারা পৌর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার প্রামাণিক বুধবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি সেখানে ছয় দিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ ঘটনা কেন্দ্র করে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা ভেড়ামারা শহরের ডাকবাংলার সামনে জড়ো হয়ে অভিযুক্ত যুবজোট নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসন থেকে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হলেও তাঁদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। উল্টো দলটির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম করেন। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর ভোট করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমুল হক বলেন, ‘জাসদ নেতা-কর্মীরা এখানে অস্ত্রের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তাঁরা বারবার আমাদের দলের নেতাদের ওপর হামলা করছেন, মামলা দিচ্ছেন। এতে করে দলের নেতারা এখন ক্ষুব্ধ।’
তবে তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী অভিযোগ করেন, জাসদের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কারও কারও ব্যক্তি সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। তেমন কাজ থেকে যেসব অর্থ পাওয়া যায়, তা এক টেবিলে বসে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে থাকে রাতের আঁধারে। পদ্মায় বালুমহাল থেকে দুই দলের নেতারা অবৈধভাবে বালু তুলে বিক্রি করেন। এই নেতারা রাজপথে একে অন্যকে ঘায়েল করে বক্তব্য দেন, যা লোকদেখানো। তবে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে জাসদের দা-কুমড়া সম্পর্ক। এর মাঝে দুই দলের নেতা-কর্মীদের একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া মিরপুর উপজেলাতেও জাসদ নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক সাপে-নেউলে। এখানে জাসদ নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো বনিবনা নেই।
মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন বলেন, ‘আমরা তিনটা নির্বাচন পরপর ইনু সাহেবের পক্ষে করেছি। নির্বাচনের পর উনি (ইনু) আমাদের কথা ভুলে যান। উল্টো আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন। এবার নির্বাচনে আমরা ভোট দিলেও সাধারণ মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন বলে মনে হয় না।’
তবে ভেড়ামারা উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী বলেন, ‘কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। তবে এসব ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যক্তিগত কারণে এসব ঘটতে পারে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের সম্পর্ক আগের থেকে ভালো।’
জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম ওরফে স্বপন বলেন, ভেড়ামারায় যত ঘটনা ঘটেছে, তা স্থানীয় ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত। এমনকি পাড়া–মহল্লার বিরোধে মারামারি-খুন হয়। এতে রাজনৈতিক কোনো বিষয় থাকে না। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু কুচক্রী মহল এটাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। এটাকে শক্ত হাতে দমন করতে জাসদ প্রস্তুত রয়েছে।