ওএমএসের চাল-আটার জন্য গাজলী বেগমের ২৮ ঘণ্টার অপেক্ষা

পাঁচ কেজি চাল আর আটার জন্য গাজলী বেগম অপেক্ষা করেছেন ২৮ ঘণ্টা। গতকাল সকাল আটটার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বিশ্বরোড মোড়ে
ছবি: প্রথম আলো

আধাপাকা দোকানের মেঝেতে শুয়ে আছেন কয়েকজন নারী। কাঁথা মুড়ি দিয়ে অনেকে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। ঘড়িতে তখন রাত ১১টা। বাইরে শীতের আগমনী হিমেল হাওয়া বইছে। মেঝের এক পাশে ভাঙা ইট আর পিঁড়ির সারি। মেঝেতে যাঁরা শুয়েবসে আছেন, তাঁরা মূলত ওই ইট আর পিঁড়িগুলো পাহারা দিচ্ছেন। পরদিন সকালে ওই দোকানের সামনের সড়কের মোড়ে খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির চাল-আটা পাওয়া যাবে। তাই আগের রাত থেকেই ইট আর পিঁড়ি দিয়ে নারীরা পণ্যপ্রাপ্তির লাইনে নিজের অবস্থার নিশ্চিত করেছেন।

গতকাল সোমবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বিশ্বরোড মোড়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে। সেখানে পৌর এলাকার বালিগ্রামের গাজলী বেগমের (৬২) সঙ্গে কথা হয়। তাঁর সঙ্গে সরকারপাড়ার ফিরোজা বেগম (৩৮), সদর উপজেলার বারঘরিয়া ইউপির কাজিপাড়ার রোকশানা বেগম (৪২) ও পৌর এলাকার উপর রাজারামপুরের সাদিকুল ইসলামের স্ত্রী মুক্তারা বেগম (৩৮) শুয়ে ছিলেন। আরও তিনজন নারী সেখানে আছেন। তবে গাজলী ছাড়া অন্যরা কেউ কথা বলতে রাজি হলেন না। ওই নারীদের মধ্যে একজন বললেন, ‘কথা বলে কী লাভ! আপনারা কি আমাদের চাল-আটা পাইয়ে দিবেন?’

গতকাল সকাল সাতটায় গাজলী বেগম এখানে এসে অবস্থান নিয়েছেন। তবু তিনি ৩ নম্বর সিরিয়াল পেয়েছেন। এক টুকরা ভাঙা ইট রেখে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন গাজলী। কেউ যেন ইটের টুকরা সরিয়ে না দেন, সে জন্য সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি সেখানে বসেছিলেন। পরে দুপুরের ভাত খেতে বাড়িতে গিয়েছিলেন। ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার চলে আসেন ওই দোকানের সামনে। সঙ্গে প্লাস্টিকের বক্সে রাতের খাবারও নিয়ে এসেছেন।

গাজলী বলেন, ‘ছোট ব্যাটার দিন চলে না। ছোট দুটা পোতা (ছেলে) আছে। খাওয়া জুটে না ঠিক মতন। ওরঘে (ওদের) দিকে তাকিয়া আইসাছি। কষ্ট করছি। ছোট দুটা ব্যাটা রাইখ্যা স্বামী মইর‍্যা গেছে ২৫ বছর আগে। চাতালে কাম কইর‍্যা ওরাকে খাওয়ালছি। এখুনো ওদের দুখ দেখ্যা, কষ্ট করতে হইছে। কী আর করব, ব্যাটারা তো হামাকে ভালোবাসে।’

পরদিন সকালে ওএমএসের চাল-আটা দেওয়া হবে। এসব পণ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে অনেকে আগেরদিন সন্ধ্যা থেকে ডিলারের দোকানের পাশে অবস্থান নিয়েছেন

গাজলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে অন্য নারীরাও আলাপে যোগ দিলেন। মুক্তারা বেগম বিকেলে এসেছেন। তাই তাঁর সিরিয়াল কিছুটা পেছনে। মুক্তারা বেগম বলেন, ‘আগের দিন বিকালে আইস্যাও হামার সিরিয়াল ১৬ নম্বরে। আগের সপ্তাহে রাইত তিনটাতে আইস্যা ছিনু। পাইয়্যাছি খালি চাইল। আটা পাইনি। তাই এবার আগেভাগে আইস্যাছি। ভোররাইত থাইক্যা লাইনে খাড়া হই, পাইতে পাইতে দুপুর। ওই পর্যন্ত না খাইয়্যাই থাকি। নাস্তা লিয়া আসারও কেহু নাই।’

মুক্তারার পাশে বসেছিলেন ফিরোজা বেগম। তাঁর স্বামী মারা গেছেন। ফিরোজা বেগম স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আয়ার কাজ করেন। দুই সন্তান নিয়ে এই আয় দিয়ে সংসার চলে না বলে জানান তিনি। তাই আগের দিন সন্ধ্যায় লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু কাল কাঙ্ক্ষিত চাল পাবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন।

রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত সাতজন নারী ছিলেন ওই দোকানের সামনে। তবে সেখানে প্রায় ২০টি ইটের টুকরা দেখা গেল। ওই নারীরা বলেন, অনেকে ইট রেখে বাড়ি চলে গেছেন। রাত দুইটার পর থেকে আসতে শুরু করবেন। মধ্যরাতে ওই দোকানের সামনে মানুষে ভরে যাবে।

আজ সকাল আটটার দিকে বিশ্বরোড মোড়ে যান এই প্রতিবেদক। ততক্ষণে সেখানে তিন শতাধিক নারী-পুরুষ তিনটি সারিতে দাঁড়িয়ে গেছেন। এর মধ্যে দুটি সারি নারীদের। সারিতে দাঁড়ানো নিয়ে অনেকেই তখন ঝগড়া করছিলেন। সকাল ৯টা থেকে চাল দেওয়ার কথা। তবে সারিতে দাঁড়ানো নারী–পুরুষেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিবারই ডিলার আসতে দেরি করেন।

সকাল আটটার মধ্যেই ওএমএসের ডিলারের দোকানের সামনে কয়েক শ নারী–পুরুষের ভিড়

নির্ধারিত সময়ের আধা ঘণ্টা পর ডিলার বুলবুল ইসলাম সেখানে এলেন। দেরি করে আসার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই তিনি সারিতে দাঁড়ানো নারী-পুরুষের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। এরপর নিজের সিল, স্বাক্ষর ও সিরিয়াল নম্বর দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ফেরত দেন। সবার কাছ পরিচয়পত্র নিলেও সবাইকে চাল-আটা দিতে পারেন না বলে জানালেন বুলবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দিতে পারব ২০০ জনকে। মানুষ আসে ৪০০ জনের বেশি। না পাওয়া অনেকে কান্নাকাটি করে। তখন খুব খারাপ লাগে। পরের সপ্তাহে তাদের দেওয়ার চেষ্টা করি।’

চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম কেন জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন ডিলারকে এক দিনের জন্য এক টন চাল ও এক টন আটা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাঁদের কোনো সপ্তাহে দুই দিন, কোনো সপ্তাহে তিন দিনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডিলাররা এক দিনে ২০০ জনের কাছে ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি চাল ও ২৪ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি আটা বিক্রি করেন।

জাকির হোসেন আরও বলেন, বিভিন্ন ডিলারের কাছে মানুষের অতিরিক্ত ভিড়, লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির খবর তাঁদের কাছে আসে। এসব তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান যেন বরাদ্দ বাড়ে।

বেলা ১১টার দিকে গাজলী বেগমের সঙ্গে আবার দেখা। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তবে তাঁর হাতে তখন পাঁচ কেজি করে চাল ও আটা। প্রতিবেদকের মুখোমুখি হতে তিনি বলেন, ‘দেখলেন তো কাইল সকাল সাতটা থাইক্যা আইসা অ্যাতখুনে পাইনু। হিসাব কইরা দ্যাখেন কয় ঘণ্টা পরে পাইনু।’ হিসাব করে দেখা গেল, পাঁচ কেজি চাল আর আটার জন্য গাজলী বেগমকে পাক্কা ২৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো।

ওএমএসের চালের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষের অপেক্ষা নতুন নয়। আগের রাত থেকে লাইনে দাঁড়ানোর নজির চাঁপাইনবাবগঞ্জে আরও আছে। গত ২৭ নভেম্বর ‘ওএমএসের চাল ও আটা পেতে ২০ ঘণ্টা অপেক্ষা’ এবং আগের দিন ২৬ নভেম্বর ‘আগের দিন বিকেলে লাইনে’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।