দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমুর হাসান ও রিয়াদ হাসানের নাম আছে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় উপবৃত্তির তালিকায়। কিন্তু তাঁরা উপবৃত্তির ৫ হাজার ৮০০ করে টাকা পাননি। এই দুই শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তাঁদের উপবৃত্তির টাকা অন্য ব্যক্তির মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর ব্যবহার করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
নাইমুর ও রিয়াদের মতো ওই কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে অধ্যক্ষ খন্দকার মুশফিকুর রহমান ও কলেজের কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে। রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূর্বে মির্জাপুর বছির উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ। ১৯৯৪ সালে এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক (প্রয়াত) এম মতলুবর রহমান। প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখলেও কয়েক বছর ধরে নিয়োগ–বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ আছে।
কলেজটির জ্যেষ্ঠ শিক্ষক (রুটিন দায়িত্বে অধ্যক্ষ) মোজাম্মেল হক জানান, তাঁদের কলেজে একাদশ, দ্বাদশ ও স্নাতকে (পাস) মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৫০০ জন। এর মধ্যে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে দ্বাদশের ১৫৩, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একাদশের ১৫৪ জন উপবৃত্তিপ্রাপ্ত হন। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী মানবিক শাখায় ৫ হাজার ৮০০ ও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ৬ হাজার ৩০০ টাকা উপবৃত্তি পান।
৬ জানুয়ারি সরেজমিনে কলেজটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্টের আবেদন শুরু হলে শিক্ষার্থীরা কলেজের কম্পিউটার অপারেটর গৌতম কুমারের মাধ্যমে আবেদন করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের সব তথ্য দেওয়া হলেও কৌশলে তাঁদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর অন্যজনের দেওয়া হয়। তিন বছর ধরে এভাবে অনিয়ম হয়েছে। তবে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর দুর্নীতিসহ একাধিক অভিযোগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের ঘটনা প্রকাশিত হয়।
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের উপবৃত্তি বিতরণ বিবরণীতে দেখা গেছে, একাদশ শ্রেণির ছাত্রী রিশিতা খাতুন ও রায়হান শেখের সব তথ্য ঠিক আছে। কিন্তু তাদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে কলেজের হিসাব সহকারী মিথুল মিয়া ও তাঁর বাবা আবদুল হাই মিয়ার নম্বর দেওয়া হয়েছে। রিশিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির উপবৃত্তি পাননি। উপবৃত্তি জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশিত হলে মিথুল তাঁকে টাকা ফেরত দিতে চান, কিন্তু দেননি। মিথুল মিয়ার সাফ জবাব, অধ্যক্ষের ইন্ধনে এসব হয়েছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের এই চক্রে অধ্যক্ষ ছাড়াও কম্পিউটার অপারেটর গৌতম কুমার, হিসাব সহকারী মিথুল মিয়া, অফিস সহায়ক শাহানুর আলম, তরিকুল ইসলাম ও রোকনুজ্জামান জড়িত। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বিতরণ বিবরণীতে শাহানুর ও রোকনুজ্জামানের নম্বরও পাওয়া গেছে।
এই কলেজের ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের উপবৃত্তিপ্রাপ্ত তালিকা ধরে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে এই প্রতিবেদক। তাঁরা উপবৃত্তির টাকা পাননি বলে দাবি করেন। কলেজের একটি সূত্রের দাবি, গত ৩ বছরে ১১৮ জনের উপবৃত্তি আত্মসাৎ করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আখতারের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর পরিবর্তন করে কলেজের অফিস সহায়ক তরিকুল ইসলামের নম্বর দেওয়া হয়। সুমাইয়া বলেন, উপবৃত্তি আত্মসাতের ঘটনা ফাঁস হলে গত নভেম্বরে কলেজের কর্মচারী তরিকুল, রোকনুজ্জামান ও মেহেদী তাঁর বাড়িতে যান। তাঁরা আত্মসাতের টাকা ফেরত দেবেন জানিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর চান। কিন্তু তিনি সেই স্বাক্ষর দেননি। ঘটনার কথা স্বীকার করলেও তরিকুলের দাবি, তিনি টাকা ফেরত দিয়েছেন।
শুধু উচ্চমাধ্যমিকে নয়, গত তিন বছরে স্নাতক (পাস) শিক্ষার্থীদেরও উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। স্নাতক (পাস) শিক্ষার্থী আপেল মাহমুদ, সোহাগী আখতার ও মিলন মিয়া অভিযোগ করেন, তাঁদের নাম উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের তালিকায় থাকলেও তাঁরা টাকা পাননি।
কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, এসব অনিয়মের প্রতিবাদে তাঁদের আন্দোলনের মুখে গত ২৭ আগস্ট থেকে অধ্যক্ষ খন্দকার মুশফিকুর রহমান ও কম্পিউটার অপারেটর গৌতম কুমার কলেজে আসছেন না।
তবে অধ্যক্ষ খন্দকার মুশফিকুরের সঙ্গে মুঠোফোনে তিন দিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। উপবৃত্তি আত্মসাতের ঘটনায় তাঁর বক্তব্য জানতে চেয়ে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। অবশ্য গৌতম কুমার তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন।
এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবদুল মান্নানকে প্রধান করে গত বছরের নভেম্বরে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের শিক্ষার্থীদের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছেন।