পৌষসংক্রান্তি আর ‘শেরপুরের মাছের মেলা’ একই সুতোয় গাঁথা হয়ে গেছে। মৌলভীবাজারের মানুষের কাছে শতবর্ষী এই মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যের অংশ, একটি উৎসব। অন্য সব হাটবাজার যেমন সারা বছর ধরে চলতে থাকে, শেরপুরের মাছের মেলা বছরে এই একবার শুধু পৌষসংক্রান্তিতে হয়ে আসছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পারে এই মেলা বসে। এ বছরও গতকাল শনিবার রাতে বসেছিল শেরপুরের মাছের মেলা। রাতজুড়েই মেলায় পাইকারি মাছ বিক্রি হয়েছে। আজ রোববার সকাল থেকে সারা দিন ধরে খুচরা মাছ বিক্রি হয়েছে।
মৎস্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, গতকাল বিকেল থেকেই মাছের মেলা জমতে শুরু করে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দক্ষিণ দিকে এবং মৌলভীবাজার-শেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পশ্চিমের মাঠে বেরি বিল-সংলগ্ন স্থানে এই মেলা বসেছিল। মেলাটি স্থানীয় হাওর-বাঁওড় ও নদ-নদীর মাছের জন্য বেশি আকর্ষণীয়। ক্রেতাদের কাছে স্থানীয় মাছেরই কদর বেশি। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওরসহ কুশিয়ারা নদীর মাছের জোগান থাকে এই মেলায়। এবারও স্থানীয় মুক্ত জলাশয়ের মাছ মেলায় উঠেছে। আড়তগুলোতে সেই মাছ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে স্থানীয় মাছের পরিমাণ কম। দামও বেশি।
খুচরা মাছ বিক্রেতারা আসছেন, দরদাম করছেন। দামে পোষালে সেই মাছ নিয়ে যাচ্ছেন। এবার স্থানীয় হাওর-নদীর মাছের মধ্যে বড় আকারের মাছ খুব বেশি নেই। মহসিন মিয়াসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী বড় আকারের বেশ কিছু বাঘাড়, বোয়াল, আইড়জাতীয় মাছ মেলায় নিয়ে এসেছেন। প্রায় ৪৪ কেজি ওজনের একটি বাঘাড়ের দাম চাওয়া হয়েছে ১ লাখ টাকা। ১০ থেকে ১৮ কেজি ওজনের বোয়ালের কেজিপ্রতি দাম চাওয়া হয়েছে ১ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। ১১ থেকে ১২ কেজি ওজনের আইড় মাছের কেজি চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা। এ ছাড়া রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, কালবাউশসহ বিভিন্ন জাতের ছোট-বড় মাছ উঠেছে মেলায়। এসব মাছ সারা বছর ধরে শেরপুরের মাছের মেলার জন্য সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। মেলার কিছুদিন আগে থেকে এই মাছ ধরা, সংগ্রহ করা শুরু হয়।
রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাখ লাখ টাকার মাছ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বিক্রেতারা। স্থানীয় অনেক খুচরা বিক্রেতা বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ সংগ্রহ করে মেলায় নিয়ে এসেছেন। অনেক কৌতূহলী মানুষ মাছ দেখতে মেলায় ভিড় করেন। কেউ কেউ মাছ কিনে বাড়ি ফিরেছেন। সারা রাত ধরেই মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনা চলেছে। রাত-দিনে পাইকারি ও খুচরা মিলে শেরপুরের মাছের মেলায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা হতে পারে। মাছের মেলায় পাইকারি মাছ বিক্রির জন্য আফরোজগঞ্জ মৎস্য আড়তদার বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৫টি আড়তের ১৭টি দোকান ছিল।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের মনু নদ-তীরবর্তী মনুমুখ নামের একটি স্থানে শত বছর আগে এই মাছের মেলা শুরু হয়েছিল। তখন নদপথেই যোগাযোগ সহজ ছিল। স্থানীয় হাওর-নদীর বিভিন্ন জাতের বিশাল সব মাছে মেলা পরিপূর্ণ থাকত। মনু নদের ভাঙনে মনুমুখ বাজারের আয়তন ছোট হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মেলাটিকে সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুর এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। এরপর অর্ধশতাধিক বছর ধরে শেরপুরেই এই মাছের মেলা বসছে। পৌষসংক্রান্তির একদিন আগে বসে এই মেলা। মেলায় আনাজ-তরকারি, কৃষিপণ্য, গার্হস্থ্য জীবনের অন্য সব পণ্য উঠলেও এটা মাছের মেলা নামেই পরিচিতি পেয়ে এসেছে।
মেলাটি এখন এলাকার একটি ঐতিহ্য। এ এলাকার অনেক বাড়িতেই এই সময় আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসেন। অনেকে মেয়ের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সামর্থ্য মতো বড় আকারের মাছ কিনে পাঠান। তবে শেরপুর এলাকায় খোলা স্থান ও মাঠ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসায় মেলার পরিসর ছোট হয়ে আসছে।
শেরপুরের আফরোজগঞ্জ মৎস্য আড়তদার বহুমুখী সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও মেঘনা মৎস্য ভান্ডারের পরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় লোকাল মাছ কম। লোকাল মাছের দামও বেশি। তবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ আসে। রাতজুড়ে পাইকারি এবং দিনে খুচরা বিক্রি হয়। তবে মেলার জায়গা অনেকটা কমে আসছে। ঐতিহ্য হিসেবে টিকিয়ে রাখতে অনেকে ক্ষতি হলেও মেলায় দোকান দিয়ে থাকেন। মেলা চালু রাখতে সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থাপনা দরকার।’
খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু মিয়া চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় মেলা হয়। প্রতিবছর জায়গা কমছে। ঐতিহ্যবাহী বাজার, নির্দিষ্ট জায়গা নেই। মেলার একদিন আগে ডাক (ইজারা) দেওয়া হয়। প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। আগে হলে প্রস্তুতি নেওয়া যেত, মানুষ জানত।’
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাসরিন চৌধুরী বলেন, ‘মেলায় গিয়েছিলাম, চাষের মাছই বেশি দেখলাম। আগের মতো নদীর মাছ নেই। নির্বাচনের জন্য সময় কম ছিল, তাই প্রকাশ্য নিলামে ইজারা দেওয়া হয়েছে। পরেরবার থেকে এক মাস বা ১৫ দিন আগে টেন্ডার দেওয়া হবে। এবার এই মেলা ইজারা থেকে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।