যশোরের অভয়নগর উপজেলায় পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় আফরোজা বেগম (৪০) নামের এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা পুলিশ। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে (প্রশাসন ও অর্থ) প্রধান করে গতকাল রোববার রাতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত শনিবার রাত দেড়টার দিকে অভিযান চালিয়ে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের বাড়ি থেকে আফরোজা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁর কাছে ৩০টি ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। অভিযানে উপপরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সহকারী উপপরদির্শক (এএসআই) সিলন আলী, এএসআই শামসুল হক ও নারী কনস্টেবল রাবেয়া খানম ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর আফরোজাকে থানাহাজতে রাখা হয়।
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার পথে গতকাল বেলা ১১টার দিকে আফরোজার মৃত্যু হয়। যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রাত সাড়ে নয়টার দিকে পুলিশি প্রহরায় উপজেলার রেলস্টেশন কবরস্থনে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়। পরিবারের অভিযোগ, আফরোজা বেগমকে পুলিশ আটকের সময় মারধর করেছে। তাঁর চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় তারা পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করবে।
আফরোজা বেগম অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের আবদুল জলিল মোল্যার স্ত্রী। তিনি স্বামী ও এক ছেলেকে নিয়ে উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের নর্থ বেঙ্গল রোডে আক্কাস আলীর ভাড়া করা বাড়িতে বসবাস করতেন।
আজ সোমবার দুপুরে নর্থ বেঙ্গল রোডের ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এল প্যাটার্নের একটি ঘর। ঘরটিতে টিনের বেড়া। ছাউনি টিনের। এক পাশের দুটি কক্ষ ফাঁকা। মাঝখানের দুটি কক্ষের দরজায় তালা ঝুলছে। পাশের কক্ষে থাকেন অপর একজন ভাড়াটে। পাশের বাড়ির একজন নারী বলেন, মাঝের তালাবদ্ধ ঘর দুটিতে আবদুল জলিল মোল্যা, তাঁর স্ত্রী আফরোজা বেগম এবং ছোট ছেলে সাব্বির মোল্যা থাকতেন। শনিবার রাতে আফরোজাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। তাঁরা আর বাড়িতে ফেরেননি।
সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নওয়াপাড়া রেলস্টেশনের পাশে বস্তিতে আফরোজা বেগমের বাবার বাড়িতে গিয়ে স্বামী আবদুল জলিল মোল্যা, বড় ছেলে মুন্না মোল্যা ও ছোট ছেলে সাব্বির মোল্যাকে পাওয়া যায়। এ সময় আফরোজার ভাই অভয়নগর উপজেলা বাস্তুহারা লীগের সভাপতি নূর ইসলাম হওলাদারও বাড়িতে ছিলেন।
আফরোজা বেগমের ছোট ছেলে নওয়াপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির মোল্যা বলে, ‘শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আম্মু বাড়ির পাশে ডিপ টিউবওয়েলে পানি আনতে যান। এ সময় বাড়িতে পাঁচজন পুলিশ আসেন। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনের পুলিশের পোশাক পরা ছিল। তাঁদের সঙ্গে আরও অন্তত ১০ জন লোক ছিলেন। এর মধ্যে সিলন দারোগা (এএসআই সিলন আলী) আম্মুকে তাঁর কাছে যা আছে, বের করে দিতে বলেন। তাঁর কাছে কিছু নেই জানালে তিনি (সিলন আলী) আম্মুকে চড় দিতে দিতে শোয়ায়ে ফেলেন। আম্মুকে মারতে নিষেধ করলে তিনি (সিলন দারোগা) আমাকেও দুটি চড় এবং একটি লাথি মারেন। এরপর সিলন দারোগা একজন নারী পুলিশকে ফোন করে ডেকে আনেন। তিনি আম্মুর শরীর তল্লাশি করেও কিছু পাননি। এরপর আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে নারী পুলিশের সহায়তায় ঘরে দরজা দিয়ে কী করা হয়েছে, জানি না। তবে আমার সামনে চুল ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে আম্মুকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। বাইরে দাঁড়িয়ে আম্মুর চিৎকার শুনেছি।’
আফরোজা বেগমের বড় ছেলে অটোরিকশাচালক মুন্না মোল্যা বলেন, ‘আমি পাশে ভাড়া থাকি। শনিবার রাতে খবর পেয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে আম্মুদের ভাড়া করা বাড়িতে পৌঁছাই। পুলিশ কোথা থেকে এক লোককে ধরে এনে ২৩টি ইয়াবা বড়ি দিয়ে আম্মুকে বলে, “তুই দিয়েছিস।” এ সময় মায়ের কাছে টাকা দাবি করা হয়, না হলে মাকে ২০০ ইয়াবা দিয়ে চালান করে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়। মাকে মারধরের পর রাত দুইটা-তিনটার দিকে পুলিশ তাঁকে ভ্যানে করে অভয়নগর থানায় নিয়ে যায়।’
মুন্না মোল্যা অভিযোগ করেন, তাঁর বাবার অটোরিকশা বিক্রির ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা এবং গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাঁর মামির নামে তোলা ৫০ হাজার টাকা ঘরের শোকেসের ড্রয়ারে রাখা ছিল। এই টাকা দিয়ে তাঁর বাবার চিকিৎসা করার কথা ছিল। ড্রয়ারে একটি সোনার কানের দুল ও একটি আংটি ছিল। পুলিশ টাকা ও গয়না নিয়ে গেছে।
তবে এএসআই সিলন আলী প্রথম আলোকে বলেন, আফরোজা বেগম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের নামে বেশ কয়েকটি মাদকের মামলা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। টাকা দাবি এবং টাকা ও গয়না নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
আফরোজা বেগমের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। এএসআই সিলন আলী বাদী হয়ে রোববার রাতে অভয়নগর থানায় মামলাটি করেন।
আগে মাদক বিক্রির কথা স্বীকার করে আবদুল জলিল মোল্যা বলেন, ‘আমার নামে দুটি মাদকের মামলা ছিল। এর মধ্যে একটি মামলা থেকে আমি অব্যাহতি পেয়েছি। আমি এখন আর মাদক বিক্রি করি না। আমি অসুস্থ। তারপরও ইজিবাইক চালিয়ে আয় করি। আমার স্ত্রী ভালো লোক ছিল। তাঁর নামে কোনো মাদকের মামলা ছিল না। আমার স্ত্রীকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি দুই-এক দিনের মধ্যে সিলন দারোগাসহ সেখানে উপস্থিত থাকা অন্য পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করব।’
তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (‘খ’ সার্কেল) জাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ পিস ইয়াবাসহ আফরোজা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। পরদিন তিনি হাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে অভয়নগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর ব্লাড প্রেসার ছিল ২২০ বাই ১১০। যশোরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতাল থেকে আফরোজার যে ডেথ সার্টিফিকেট (মৃত্যুসনদ) পাওয়া গেছে, সেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
জাহিদুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ সুপারের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই নারীর মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা এই কমিটি তদন্ত করে দেখবে। খুব শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে।