মাকে আর কোনো দিন ফোন দেবেন না রিফাতুল

নড়াইলের লোহাগড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত রিফাতুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে কর্মস্থল গোপালগঞ্জের উদ্দেশে বের হন মো. রিফাতুল ইসলাম। সঙ্গে ছোট মামা আজাদ মিয়া। আত্মীয় জিকু মিয়াকে নিয়ে তিনজন একটি মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন ভাটিয়াপাড়া মোড়ে। সেখান থেকে বাসে ঢাকায় যাবেন আজাদ মিয়া, রিফাতুল যাবেন গোপালগঞ্জে। পথে যাত্রীবাহী বাসের চাপায় পিষ্ট হয় মোটরসাইকেলটি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রিফাতুল ইসলামের (৩৫)।

আজাদ মিয়ার (৪৫) ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গোপালগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের সহকারী পরিদর্শক ছিলেন রিফাতুল ইসলাম। তাঁর দুই মাস বয়সী একটি মেয়ে আছে। আহত আজাদ মিয়া বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা।

গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা-যশোর মহাসড়কের নড়াইলের লোহাগড়া পৌরসভার মাইটকুমড়া এলাকায় ঘটে এ দুর্ঘটনা। লোহাগড়া থেকে ভাটিয়াপাড়র দূরত্ব আট কিলোমিটার। রিফাতুল বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলেসন্তান। বিয়ে করেছেন আড়াই বছর আগে। দুই মাস বয়সী একটি মেয়ে আছে তাঁদের। রিফাতুল বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ে মা ছিলেন কুমিল্লায়। ফোনে মায়ের সঙ্গে দুবার কথা হয়। সর্বশেষ ফোনে মাকে রিফাতুল বলেছিলেন, ‘গোপালগঞ্জে বাসায় পৌঁছে ফোন দেব, দোয়া করো।’

নড়াইলের লোহাগড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তা রিফাতুলের মায়ের আহাজারি

রোববার দুপুরে রিফাতুলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, আহাজারি করছেন পরিবারের সদস্যরা। বাড়িতে এসেছেন আত্মীয়স্বজনেরা। প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁদের। এ সময় রিফাতুলের মা মুসলিমা বেগম ‘ফোন দেয়নি রিফাতুল। আর কোনো দিন ফোন দেবে না। আর কোনো দিন তাঁর সাথে কথা হবে না। আমার একমাত্র পুত্র চোখের সামনে চলে গেলে। কী নিয়ে আমি বেঁচে থাকব?’ বলে বিলাপ করছিলেন।

১০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় একটি লাশ বহনের খাটিয়া আনতে গিয়ে ওই একই এলাকায় ট্রাকচাপায় মৃত্যু হয় তিনজনের। তাঁদের মধ্যে একজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। নিহত অন্য দুজন হতদরিদ্র পরিবারের। তাঁদের ওপর নির্ভরশীল ছিল পরিবার। ঢাকা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ওই এলাকায় প্রায়ই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।

লোহাগড়া থেকে যশোরের দূরত্ব ৫৩ কিলোমিটার। মহাসড়কের ওই ৫৩ কিলোমিটার ছিল মাত্র ১৮ ফুট চওড়া। লোহাগড়ায় কালনা সেতু চালু হওয়ার পর উভয় পাশে তিন ফুট করে চওড়া করায় বর্তমানে ২৪ ফুট হয়েছে মহাসড়কের ওই অংশ। এ ছাড়া আঁকাবাঁকা ও সরু সড়কটি ঘেষে গড়ে উঠেছে দোকানপাট ও বাজার। অনেক জায়গায় সড়কের ওপর রাখা আছে কাঠের গুঁড়ি ও বাস। এ অবস্থায় চলছে দূরপাল্লার গাড়ি ট্রাক, কার্ভাড ভ্যান ও যাত্রীবাহী পরিবহন। এ ছাড়া এ মহাসড়কে চলে ইজিবাইক, টেম্পো, ভ্যান ও মোটরসাইকেলের মতো ছোট ছোট পরিবহন।  মহাসড়কের লোহাগড়া-যশোর অংশে বেড়েই চলছে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা।

বাসচালকেরা বলছেন, দূরপাল্লার গাড়ি সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে হয়। কিন্তু মহাসড়কটি সরু ও আঁকাবাঁকা, আবার চলছে ছোট ছোট যানবাহন। আবার সড়কটি মেরামতের সময়ে দেওয়া হয়েছে পিচ্ছিল বিটুমিন। এতে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়।
যশোর থেকে লোহাগড়া পর্যন্ত ৫৩ কিলোমিটারের দায়িত্বে থাকা নড়াইলের তুলরামপুর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে মামলা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মূল ব্যাপারটি হলো সরু সড়ক, বাঁক বেশি। তাই প্রায়ই এ অংশে দুর্ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভগের নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় সড়ক সরু হওয়ায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। দুর্ঘটনা এড়াতে হলে ঢাকা-ভাঙ্গার মতো ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল সড়ক হতে হবে। ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল সড়কটি চার লেন করতে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।