দুপুর ১২টা। পানিশূন্য চিকলী নদীর বুক খাঁ খাঁ করছে। তবু নদীর বুকে কয়েকটি সাদা বকের ওড়াউড়ি দেখা গেল। হয়তো মাছ শিকারের আশায় বকদের নিষ্ফল আনাগোনা। ওই নদীর পূর্ব পারে দেড় শ গজ দূরেই সুফিয়াদের বাড়ি।
৩৩ বছর ধরে নিখোঁজ সুফিয়ার অনুপস্থিতি নদীর মতোই খাঁ খাঁ করে রেখেছিল ১১ ভাইবোনের বুক। গত সোমবার বোনের সন্ধান পেয়েছেন তাঁরা। এখন দুশ্চিন্তা ঝেড়ে সুফিয়া বিবির ফেরার অপেক্ষায় বুক বেঁধে আছেন ভাইবোনেরা।
আজ শুক্রবার বদরগঞ্জ মেলার মাঠ ধরে চিকলী নদীর নাওপাড়া খেয়াঘাট পেরিয়ে সুফিয়ার বড় ভাই সহিদার রহমানের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে বাড়িতে ছিলেন সুফিয়ার অন্য তিন ভাই ও চার বোন। জানা গেল, পাকিস্তানে বোনের সন্ধান পাওয়ার পর সবাই সুফিয়ার ফেরার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। এখন স্বজনদের একটাই প্রশ্ন, কবে ফিরতে পারবেন সুফিয়া?
বদরগঞ্জ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের কাশীগঞ্জ নাওপাড়া গ্রামে সুফিয়াদের বাড়ি। অভাবের তাড়নায় ১৯৯০ সালে অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর খোঁজ মেলেনি সুফিয়ার। মা–বাবা ও ভাইবোনেরা অনেক খুঁজেছিলেন। কিন্তু কোথাও সন্ধান না পেয়ে ধরেই নিয়েছিলেন, সুফিয়া আর বেঁচে নেই। ৩৩ বছর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গত সোমবার সুফিয়ার সন্ধান পান স্বজনেরা।
সুফিয়া বর্তমানে পাকিস্তানের করাচি শহরের ছোট একটি গ্রামে বসবাস করছেন। সোমবার সন্ধান পাওয়ার পর আজ শুক্রবার দুপুরে দ্বিতীয় দফায় সুফিয়ার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছেন ভাইবোনেরা। এ সময় সুফিয়া দ্রুত স্বজনদের কাছে ফেরার আকুতি জানান। স্বজনেরা জানান, সুফিয়া বিবিরা ছয় ভাই ও পাঁচ বোন। সবাই বেঁচে আছেন। তবে মা-বাবা বেঁচে নেই। বেঁচে নেই সুফিয়ার রেখে যাওয়া দুই সন্তান।
সুফিয়ার বড় ভাই মাছ ব্যবসায়ী সহিদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজের আগে বদরগঞ্জ উপজেলার মোস্তফাপুর বারোবিঘা শৌলাপাড়া গ্রামে সুফিয়ার বিয়ে হয়েছিল। তাঁর স্বামী দিনমজুরি করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর সুফিয়া দুই শিশুসন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে না পেরে ১৯৯০ সালে সন্তানদের রেখে অভিমান করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন। এরপর তাঁর আর সন্ধান মেলেনি।
সুফিয়ার ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় নুরজাহান বেগম (৮০)। বৃদ্ধ হলেও তিনি এখনো চলাফেরা করতে পারেন। স্মৃতিশক্তিও প্রখর। নুরজাহান বেগম বললেন, ‘আমরা ছয় ভাই, পাঁচ বোন। অভাবের কারণে আমরা কেউ পড়াশোনা করতে পারিনি। আমার বাবা চান মিয়া বদরগঞ্জ বাজারে সবজি বিক্রি করতেন। সামান্য আয়ে ১৩ জনের মুখে খাবার তুলে দিতেন। তখন খুব অভাব ছিল। কোনো কোনো দিন আমাদের না খেয়ে কাটাতে হতো। কখনো এক পোয়া চালে কচুশাক ও লবণ দিয়ে মা মাড়িভাত রান্না করে দিত। এরপর ১১ ভাইবোনকে ঘরের মেঝেতে সারি করে বসিয়ে খাইয়ে দিত। দেখতাম, একজনকে খাওয়ানোর পর আরেকজন আবার হাঁ করে থাকত। তখন আমরা কেউই আলাদা থালায় ভাত খেতে পারিনি। খিদের জ্বালায় কোনো কোনো সময় কচুশাক, কলা ও মাজা সেদ্ধ করে খেয়েছি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নুরজাহান বলেন, ‘সুফিয়া নিখোঁজ হওয়ার পর মা-বাবা খুব দুশ্চিন্তা করতেন। একপর্যায়ে ২০০৩ সালে প্রথমে বাবা ও পরে মা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। বোন হারিয়ে গেলেও সব সময় নামাজ পড়ে তার জন্য দোয়া করতাম। সুফিয়া বেঁচে আছে, এটা এখন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।’ একপর্যায়ে প্রশ্ন রাখেন, ‘বাবা, পাকিস্তান থেকে আমার বোনের দেশে আসতে কত দিন সময় লাগবে?’
আরেক বোন মাহমুদা খাতুন (৬৫) বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে সুফিয়া বাবার সংসারে ফিরে চরম অন্নকষ্টে পড়ে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সবাইকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়। একপর্যায়ে তিন বছর বয়সে তার ছোট মেয়ে ছোবেদা ডায়রিয়ায় মারা যায়। বড় মেয়ে জোবেদার ঠাঁই হয় বড় ভাই সহিদারের সংসারে। মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বিয়ে দিলেও কখনো স্বামীর সংসারে যায়নি। হতাশায় মা কোথায় আছে জানতে চাইত। আমরা বলতাম, ঢাকায় আছে, সময় হলেই আসবে। এভাবে একদিন হঠাৎ সে-ও নিখোঁজ হয়ে যায়। তখন থেকে তার আর সন্ধান পাইনি। হয়তো জোবেদাও মারা গেছে।’
সুফিয়ার ছোট ভাই মোজাফ্ফর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভিডিও কলে কথা বলার সময় সুফিয়া প্রথমে মা–বাবা ও তার দুই মেয়ের খবর জানতে চায়। তারা সবাই মারা গেছে জানানোর পর সুফিয়া খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। পরে ১১ ভাইবোনকে ভিডিও কলে দেখে কিছুটা সংবরণ করে নিয়ে বলে, “আমি তোমাদের কাছে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু কীভাবে যাব, বুঝতে পারছি না।”’
সুফিয়ার নিঃসন্তান বড় বোন নুরজাহান বেগমের স্বামী আলতাফ হোসেন অনেক আগে মারা গেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনিও ভাই সহিদার রহমানের বাড়িতেই থাকেন।
সহিদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, সুফিয়া আর বেঁচে নেই। ৩৩ বছর পর পাকিস্তানে তাঁর খোঁজ পাওয়ার পর আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে ঈদের আনন্দ দেখা দিয়েছে। আমরা সবাই তার ফিরে আসার জন্য অধীর অপেক্ষায় আছি। এখন কীভাবে তাকে ফেরানো যাবে, কূলকিনারা পাচ্ছি না। সরকারের কাছে বোনকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
সহিদার রহমান আরও জানান, আগের মতো অভাব তাঁদের ভাইবোনদের মধ্যে আর কারও নেই। সবাই এখন সচ্ছল। ছোট বোন সুফিয়ার খোঁজ পাওয়ার পর একটা পাকা ঘর ধুয়েমুছে আসবাব দিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছেন। তাঁর জন্য দুটি নতুন শাড়িও কিনে ফেলেছেন। ফিরে আসামাত্রই যেন তাঁর কোনো কিছুর অভাব না হয়, সেটা তাঁরা খেয়াল রাখছেন।