সারিবদ্ধ লাশ। বুকে সাদা কাগজে লেখা একটি টোকেন। টোকেনে নিবন্ধন নম্বর, তারিখ ও সময় লেখা। ছবির সঙ্গে অবয়ব মিলিয়ে লাশটি তোফাজ্জল হোসেন খানের (২৭) বলে শনাক্ত করেন স্বজনেরা। শরীরে ছররা গুলি নিয়েই গত ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেন। সেদিন মাথার পেছনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তাঁর লাশ পান স্বজনেরা। ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো হাসপাতাল থেকে মৃত্যুসনদ পায়নি পরিবার।
তোফাজ্জল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ভালুকজান মহল্লার মৃত নেকবর আলীর ছেলে। মায়ের নাম মমতাজ বেগম। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ছিলেন তৃতীয়। মিরপুর–১১ নম্বর এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তাঁর ১১ মাস বয়সী একটি মেয়ে আছে।
স্বজনেরা জানান, ৫ আগস্ট বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে মিরপুর-২-এর স্টেডিয়াম এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন তোফাজ্জল। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে তোফাজ্জলের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাচ্ছিলেন স্বজনেরা। এরপর সহকর্মী ও স্বজনেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। মিরপুর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে তোফাজ্জলের ছবি দেখালে হাসপাতালের লোকজন তাঁকে শনাক্ত করেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে তোফাজ্জলের লাশ পাওয়া যায়। স্বজনেরা জানতে পারেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয় লোকজন তোফাজ্জলকে ওই হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠান। অজ্ঞাতনামা হিসেবে ৫ আগস্ট রাতে লাশ ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। মরদেহের বুকে লাগানো টোকেন থেকে তাঁরা সময়টি জানতে পারেন। ৬ আগস্ট বিকেলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ বাড়িতে এনে দাফন করা হয়।
তোফাজ্জলের বড় ভাই মোফাজ্জল হোসেন খান ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় কাজ করেন। তিনি বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই অংশ নিচ্ছিলেন তোফাজ্জল। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগের দিন শরীরের বিভিন্ন অংশে সাতটি রাবার বুলেট লেগেছিল। পরদিন আবার মিছিল করতে গেলে পেছন দিক থেকে গুলি লাগে। মাথার পেছনে দুটি গুলি লেগে একটি বেরিয়ে গেলেও অন্যটি আটকে ছিল। তিনি আরও বলেন, ‘গুলি লাগার পরপরই আমার ভাই মারা গেছিল বলে শুনেছি। ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলের মেঝেতে শোয়ানো অবস্থায় লাশ পাই। তোফাজ্জলের সঙ্গে মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও টাকা কিছুই পাওয়া যায়নি।’
ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর মায়ের সঙ্গে সন্ধ্যার পর কথার কথা জানিয়েছিলেন তোফাজ্জল হোসেন। তার আগেই বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘সেদিন বেলা দুইটার দিকে ফোন করলেও কথা বলতে পারিনি। বলেছিল, সন্ধ্যায় ফোন করবে। ছেলে ফোন না করায় আমি কয়েকবার চেষ্টা করে বন্ধ পাই। তখন ওর সহকর্মী ও মালিককে ফোন করি। কিন্তু কেউ বলতে পারছিল না। পরের দিন তোফাজ্জলকে পাওয়া গেছে বলে। তখনই আমি বুঝে যাই, আমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার বাবা তো আর আমার সঙ্গে কথা বলতে পারল না। আমার ছেলেরে যারা মারছে, তাদের বিচার চাই।’
বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল তাসফিয়া। বাবা কী জিনিস, বোঝার আগেই তাকে ছেড়ে গেছেন বাবা তোফাজ্জল। তোফাজ্জলের স্ত্রী হামিদা খাতুন বলেন, ‘৪ আগস্ট রাতেও রাবার বুলেট খেয়ে আসার পর কথা হয়েছিল। তখন বলেছিল, “আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার সন্তানকে দেখে রাখবা না?” ৫ আগস্ট বেলা তিনটার দিকে সর্বশেষ আমার সঙ্গে কথা হয়। বলেছিল, স্টেডিয়ামের মধ্যে আছে। আমি তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলি। চলে যাবে বলেছিল। রাতে কথা বলবে কথা দিয়েছিল। কিন্তু আর কথা বলতে পারেনি।’
হামিদা খাতুন বলেন, ‘স্বামী আমাদের অথই সাগরে ফেলে চলে গেছে। মেয়ে তার বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। ব্যানারে থাকা ছবি দেখে বাবাকে ধরতে চেষ্টা করে। বাবাকে ডাকে। সে (তোফাজ্জল) সব সময় আমার কথা শুনলেও সেদিন আমার কথা না শুনে আন্দোলনে যায়।’
৬ আগস্ট দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে তোফাজ্জলের লাশ পান স্বজনেরা। তখন বুকে একটি টোকেন ছিল। তাতে নিবন্ধন নম্বর দেওয়া হয়। হাসপাতালে সেদিন কোনো পুলিশ বা চিকিৎসক ছিল না। যার কারণে ময়নাতদন্ত করা যায়নি। হাসপাতাল থেকে মৃত্যুসনদও দেওয়া হয়নি। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুসনদের জন্য ২০ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন মোফাজ্জল হোসেন খান।
মোফাজ্জল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন আমরা লাশ গ্রহণ করি, ডেথ সার্টিফিকেট (মৃত্যুসনদ) পরে নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ১৯ আগস্ট হাসপাতালে গেলে পরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সার্টিফিকেট দেবে বলে জানায়। ওই অবস্থায় মৃত্যুসনদের জন্য লিখিতভাবে আবেদন করে অপেক্ষা করছি। জানি না কবে পাব। লাশের সঙ্গে থাকা টোকেন নম্বরটি সংরক্ষণে রেখেছি।’
তোফাজ্জল হোসেন খান গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় বড় ভাই মোফাজ্জল হোসেন খান বাদী হয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৭ আগস্ট একটি মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আরও ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ন্যায়বিচারের জন্য মামলা করেছি।’