‘আমার বাবা তো আন্দোলনে যায়নি, কেন গুলি করা হলো’

ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ভ্যানচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা
ছবি: সংগৃহীত

ভ্যানে করে দোকানে দোকানে মালামাল পৌঁছে দিয়ে যা আয় করতেন, তা দিয়েই চার সদস্যের সংসার চালাতেন জাহাঙ্গীর হোসেন মৃধা (৫১)। কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাতমুখর পরিস্থিতিতে চার দিন তিনি ভ্যান চালাতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়েই ১৯ জুলাই সকালে ভ্যান নিয়ে বের হন জাহাঙ্গীর। পরিকল্পনা ছিল সবজি কিনে, তা বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে বাসায় ফিরবেন। এ জন্য তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় যান। সেখানে সকাল ১০টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জাহাঙ্গীর।

জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের দ্বিপাশা গ্রামে। ওই গ্রামের মঈনুদ্দিন মৃধার ছেলে তিনি। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন জাহাঙ্গীর। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পৈতৃক সূত্রে মাত্র দেড় শতাংশ জমির মালিক ছিলেন তিনি। যেখানে ঘর উঠিয়ে থাকার মতো সামর্থ্য ছিল না। তাই স্ত্রী লাইজু বেগমকে নিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। বছরে এক-দুইবার বাড়ি আসতেন জাহাঙ্গীর। বাড়িতে নিজের ঘর না থাকায়, থাকতেন একই গ্রামে শ্বশুর মো. মোসলেম জোমাদ্দারের বাড়িতে।

গতকাল সোমবার দুপুরে দ্বিপাশা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ে জাহাঙ্গীর আলমের কবর। ১৯ জুলাই রাতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে জাহাঙ্গীরকে দাফন করা হয়। দাফনের দুই দিন পর স্ত্রী লাইজু বেগম ১৮ বছরের মো. সুজন ও তিন বছরের ছেলে মো. শান্তকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান।

নিহত জাহাঙ্গীরের বড় ভাই আবদুল গণি মৃধা (৬৭) প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন জাহাঙ্গীর। অভাবের কারণে ছেলে সুজনকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। সুজন বর্তমানে একটি দোকানে কাজ শিখছেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছে তাঁর ছোট ভাইয়ের পরিবারটি।

আবদুল গণি আরও বলেন, এ ঘটনায় তাঁরা মামলা করবেন না। কারণ, মামলা চালানোর মতো শক্তি ও সামর্থ্য কোনোটাই তাঁদের নেই। তিনি নিহত ভাইয়ের দুই ছেলে ও স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

আন্দোলনের কারণে স্বামীর আয়-রোজগারও বন্ধ হওয়ায় ঘরে খাবার ছিল না বলে জানান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী লাইজু বেগম (৪০)। মুঠোফোনে কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এ কারণে নিরুপায় হয়ে ধারদেনা করে কিছু টাকা নিয়ে তাঁর স্বামী শুক্রবার সকালে (১৯ জুলাই) বের হন। উদ্দেশ্য ছিল যাত্রাবাড়ী থেকে সবজি কিনে ভ্যানে করে বিক্রি করবেন এবং ওই বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে সংসারের জন্য চাল-ডাল কিনে বাসায় ফিরবেন, কিন্তু তা আর হয়নি। তাঁর নিরপরাধ স্বামীকে পুলিশে গুলি করছে, এই বিচার করবে কে—প্রশ্ন করেন লাইজু। তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমার বেঁচে থাকা না-থাকা সমান কথা। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে কীভাবে বাঁচব, সংসার চলবে কেমনে?’

জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে সুজন বলেন, ‘আমার বাবা তো আন্দোলনে যায়নি। আর সে কোনো দলও করে না। তাহলে আমার বাবাকে গুলি করা হলো কেন? সরকারের কাছে এর বিচার চাই।’