রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসি চত্বরে ১২টি পিঠার দোকান আছে। সবগুলোতে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকার নারীরা। আজ রোববার সন্ধ্যায়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসি চত্বরে ১২টি পিঠার দোকান আছে। সবগুলোতে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকার নারীরা। আজ রোববার  সন্ধ্যায়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে পিঠাপুলির উৎসব, শিক্ষার্থী ও নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ

বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ চলছে। মাঠভরা সোনালি ধান উঠছে কৃষকের ঘরে। উত্তরের হিমেল হাওয়া জানান দিচ্ছে শীত এসেছে। এই সময় শীতের আমেজে বাঙালির ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠাপুলির উৎসব। গ্রামের চিত্র এ রকম হলেও শহুরের জীবনে ব্যস্ততা ও ভিন্নতা থাকায় সেই চিত্র কম দেখা যায়। শহরে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতে আয়োজন করে পিঠা উৎসবের। ব্যতিক্রমী আয়োজন চোখে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শীতের পুরোটা সময়ই পিঠা উৎসব লেগে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন (টিএসসিসি) কেন্দ্রে। আড্ডা-গানে ও মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে প্রতিদিনই সরগরম থাকে চত্বরটি।

গোধূলি বিকেল ও আবছা কুয়াশার আবরণ পড়ার আগেই শুরু হয় পিঠা বানানোর কর্মযজ্ঞ। সেখানে খোলা আকাশের নিচে সারি সারি সাজানো মাটির চুলা। এতে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। চুলার ওপর বসানো হাঁড়িতে বানানো হচ্ছে মুখরোচক নানান পিঠা। কারিগর হিসেবে কাজ করছেন নারীরা। মানুষের বসার জন্য সবুজ ঘাসের ওপর রঙিন পাটি ও চেয়ার বসানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পিঠার স্বাদ নিতে উৎসবে অংশ নিচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, টিএসসিসি চত্বরে ১২টি পিঠার দোকান আছে। এসব দোকানে প্রায় ১৫ ধরনের পিঠা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, তেল পিঠা, পাটিসাপটা, পুলি পিঠা, রস পিঠা, বকুল পিঠা, লাভ পিঠা, বিস্কুট পিঠা, ঝালপোয়া, চিকেন পুলি, দুধ চিতই ইত্যাদি। এসব পিঠাকে আরও সুস্বাদু করতে পাওয়া যায় ৭ পদের ভর্তা। বেগুন, শুঁটকিভর্তা, শর্ষে, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচের ভর্তার সঙ্গে কালো জিরার ভর্তাও আছে। পিঠাভেদে দামেরও তারতম্য আছে। প্রতিটি স্পেশাল ভাপা পিঠা ২০ টাকা, সাধারণ ভাপা পিঠা ১০ টাকা, তেল পিঠা ১৫ টাকা, পাটিসাপটা ১৫ টাকা, চিতই পিঠা ১০ টাকা, পুলি পিঠা ৬ টাকা, রস পিঠা ১০ টাকা, বকুল পিঠা ৮ টাকা, লাভ পিঠা ১০ টাকা, বিস্কুট পিঠা ৬ টাকা এবং প্রতি প্লেট ভর্তা ১০ টাকা রাখা হয়। পরিধিভেদে প্রতিটি দোকানে দৈনিক আয় হয় ১০-৪০ হাজার টাকা।

নগরের পদ্মা আবাসিক এলাকা থেকে পরিবার নিয়ে পিঠা খেতে এসেছেন নাজমুল ইসলাম। তিনি চাকরি সূত্রে এই শহরে বসবাস করছেন। গত শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘শীত মানেই পিঠাপুলির উৎসব। ছুটি না থাকায় বাড়িতে যাওয়া হয়নি। তাই পরিবার নিয়ে পিঠা খেতে এসেছি। এখানকার পরিবেশ অনেকটা ভালো। হরেক রকমের পিঠা পাওয়া যায়। দামও নাগালের মধ্যে রয়েছে।’

প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন

নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ

দোকানগুলোতে পিঠা তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করেন বিভিন্ন বয়সী নারী। ১২টি স্টলে অন্তত ৬০ জন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এখানে কাজ করার আগে তাঁরা প্রায় সবাই বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। সংসারে সচ্ছলতার আশায় তাঁরা এখানে কাজ করছেন। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন। তবে তাঁরা আর্থিকভাবে মজুরি–বৈষম্যর শিকার হচ্ছেন। ৭-৮ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা মজুরি পান মাত্র ১৫০-২০০ টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় মর্জিনা বেগমের বাড়ি। রিকশাচালক স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। দুই ছেলের পৃথক সংসার। এক মেয়েকে নিয়ে মর্জিনার আলাদা সংসার। আগে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতার আশায় কাজ শুরু করেন পিঠার দোকানে। এখান থেকে যে টাকা উপার্জন করেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে যা দিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাওয়াও ঠিকমতো হয় না। শুধু মর্জিনা নয়, যাঁদের হাতে তৈরি হয় হরেক রকমের সুস্বাদু পিঠা সেসব নারীই পাচ্ছেন কম টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পিঠার স্বাদ নিতে উৎসবে অংশ নিচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ

পিঠা তৈরির কারিগর রিনা বেগম বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে পিঠার দোকানে কাজ শুরু করছি। যেদিন মালিকের ব্যবসা ভালো হয়, সেদিন ২০০ টাকা, আর অন্যান্য দিন ১৫০ টাকা করে মজুরি দেয়। তা দিয়ে সংসার তো দূরের কথা, নিজের খরচটাই হয় না। তারপরও পেটের দায়ে অল্প টাকাতেই কাজ করি।’

দীর্ঘ সাত বছর ধরে পিঠার দোকানে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মেহেরচণ্ডী এলাকার আমেনা বেগম। তিনি বলেন, ‘পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন থেকে এখানে কাজ করতে আসি। বিকেলে ৪টার দিকে কাজ শুরু করি, শেষ হয় রাত ১০টায়। এর আগে পিঠার উপকরণ প্রস্তুত ও ভর্তা তৈরি মিলিয়ে আরও ঘণ্টাখানেক কাজ করতে হয়। এই শ্রমের বিনিময়ে কোনো দিন ১৫০ টাকা, আবার কোনো দিন ২০০ টাকা দেয়। বর্তমান বাজারে এ টাকা দিয়ে পরিবার চলে না।’

শিক্ষার্থীরাও উদ্যোক্তা

পড়াশোনার পাশাপাশি টিএসসির পিঠা উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা চারটি স্টল বসিয়েছেন। পিঠা বিলাস, পিঠা কুঞ্জ, আরইউ পিঠার স্বর্গ ও টিএসসি পিঠা ঘর নামের স্টলগুলো শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করছেন। নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁরা নিজেরাও আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন।

পিঠা বিলাস স্টলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের পাঁচজন শিক্ষার্থী পরিচালনা করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা এবং ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো কিছু না করে বসে থাকার চেয়ে কিছু করার চেষ্টা করা অনেক ভালো। সেই ধারণা থেকেই মৌসুমি এই পিঠা উৎসবকে কাজে লাগানোর জন্য পাঁচজন শিক্ষার্থী মিলে এই স্টল বসিয়েছি। আমাদের দোকানে ছয়জন নারীর কর্মসংস্থানও হয়েছে। দাম সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছি। সব মিলিয়ে মানুষের সাড়া পাচ্ছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা চারটি স্টল বসিয়েছেন

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ ক্যাম্পাসের আশপাশের ব্যবসায়ীরা সেখানে স্টল বসিয়েছেন। প্রতিদিন অনেক লোক ওই পিঠা উৎসবে আসেন। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমার কাছে কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন—সেখানে নারীরা মজুরি–বৈষম্যর শিকার হচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অভিযান চালাব। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে, যাতে কেউ বৈষম্যর শিকার না হয়।’