দেশের মৌয়াল, চাষি, বণিক, গবেষক ও ভোক্তার জাতীয় জোট মৌমাছি ও মধু উৎসবের আয়োজন করেছিল। এটি তাদের চতুর্থ জাতীয় সম্মেলন।
সবার মুখে মধুমাখা পানের খিলি। এ শুধু কথার কথা নয়, নানা মসলার সঙ্গে মধু দিয়েই পান সাজা হচ্ছে। চিনির বদলে চা হচ্ছে মধু দিয়ে। একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো। একদল পক্ষ নিল বুনো মৌমাছির। আরেক দল নিল চাষের মৌমাছির পক্ষ।
মঞ্চ থেকে ঘোষণা এল, যদি বুনো মৌমাছির দল জয়ী হয় তাহলে বুঝতে হবে, বুনো মৌমাছির মধুতেই বেশি শক্তি। আর যদি চাষের মৌমাছির দল জয়ী হয়, তাহলে বুঝতে হবে চাষের মধুই সেরা।
এমন সব মজার মজার আয়োজন ছিল উৎসবে, যার নাম ছিল ‘মৌমাছি ও মধু’। দেশের মৌয়াল, চাষি, বণিক, গবেষক ও ভোক্তার জাতীয় জোট এর আয়োজন করেছিল। এটি তাদের চতুর্থ জাতীয় সম্মেলন। গত শনিবার নাটোরের লালপুর উপজেলার একটি পার্কে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জোটের আহ্বায়ক মো. আকমুল হোসেন মাহমুদের কাছ থেকে জানা গেল, ২০১৯ সালে এর যাত্রা শুরু হয়েছে। এই জোটের সদস্য প্রায় ২০ হাজার। তাঁরা মৌমাছি ও মধুবিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রদর্শনী, সভা, সেমিনার, মধু মেলা, সুন্দরবনে হানি ট্যুরিজম নিয়েও করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় এই আয়োজন।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, কীটতত্ত্ববিদ, বিচারক, মৌয়াল, চাষি, ভোক্তা অনেকেই। তাঁদের কথা থেকে জানা যায় সব বিস্ময়কর তথ্য। দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার টন চাষের মধু উৎপাদিত হয়। সুন্দরবন থেকে আসে ৬০০ টন।
গাজীপুরের এবাদুল্লাহ আফজাল বছরে ৯০০ টন মধু বিদেশে রপ্তানি করেন। এক বক্তা বললেন, ‘আপনারা মধু দিবস, মধুবর্ষ ঘোষণা করেন। মধুর ব্র্যান্ডিং করেন। তাহলে মধুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাবে।’ এরই মধ্যে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (ডিজি) ওমর আলী অনেক কথার মধ্যে একটি কথা বলে সবাইকে সতর্ক করলেন, ‘আপনাদের মধুর কোয়ালিটির সঙ্গে আপস করা চলবে না।
তা করলে শাস্তির ব্যবস্থাও থাকা দরকার।’ এতে সহমত পোষণ করলেন চাষিরাও। বক্তৃতার সময় যত মানুষ ছিলেন হলের ভেতরে, তার চেয়ে বাইরে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। তাঁরা বক্তৃতার দিকে কান না দিয়ে একজন আরেকজনের কথা শুনছেন। সব কথা মধু নিয়ে। এরই মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মৌয়াল মুক্তার হোসেন গাজীর কথা শুনে থমকে দাঁড়াতে হলো। তাঁর বয়স ৪৮ বছর। তিনি ৯ বছর বয়স থেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ করেন। এক দিনে চার মণ মধুও ভেঙেছেন।
তবে একা নন। ১২ জন মিলে। এর মধ্যে ছয় মাস শুধু সুন্দরবনে যাননি। ছয় মাস কেন যাননি, তার উত্তরে মুক্তার হোসেন যা বললেন, তাতে গায়ের রক্ত হিম হয়ে এল। বললেন, ‘১৯৯০ সালের কথা। সুন্দরবনের নদী চুনকুড়িতে আমাকে বাঘে ধরল, পানিতে ডুবে গেলাম। বাঘ তা-ও ছাড়েনি। ওপর থেকে সবাই খুঁজছে। কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কারণ, আমরা ডুবে আছি। থাবা দিয়ে আমাকে ধরে আছে। আমার তখনো হুঁশ আছে যে আমাকে বাঘে ধরেছে। আমি ছোটার চেষ্টা করি, বাঘ আরও চেপে ধরে।
আমি নদীর মাঝবরাবর ডুব দিই। একসময় বাঘ আমাকে ছেড়ে দিল। কীভাবে দিল, জানি না। এটা আল্লাহর কুদরত। সারা গা বাঘের থাবায় ছিলে গেল। ছয় মাস লাগল ঘা শুকাতে। তাই ওই ছয় মাস যাতি পারিনি। তার পর থেকে আবার যাচ্ছি।’ কোনো ভয় লাগে কি না, এর উত্তরে মুক্তার হোসেন বললেন, ‘উডারে তো দেখা যায় না। হঠাৎ আইসে ধরে।
আপনি সুন্দরবনে গেলে আপনারও ভয় লাগবে না।’ শেষে বললেন, ‘২০১৬ সালে ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে মৌ মেলার আয়োজন করিল, সেখানে আমার ডাক পড়িল।’ মুক্তার হোসেনের মুখে তখন বাঘকে হার মানানোর হাসি।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে শুরু হলো প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। একবার বুনো মৌমাছির দল গোল করল। শোধ করে আবার গোল দিল চাষের মৌমাছির দল। এরপর গোলের আর হিসাব নেই। রেফারি চট্টগ্রামের সৈয়দ মো. মঈনুল আনোয়ার বললেন, দুই দলই জয়ী হয়েছে। ট্রফি উভয়েরই। দুই দলের অধিনায়কের হাতেই ট্রফি তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু ট্রফি নিয়ে যাবে কারা। ফয়সালা হলো, ট্রফি থাকবে চট্টগ্রামের আলওয়ান মধু জাদুঘর ও গবেষণাকেন্দ্রে।