গত বুধবার ১০০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৯৩। ওই দিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন প্রায় ৫০০ রোগী।
নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ আছে ৪০টি। এর মধ্যে ২০টি খালি। আছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সংকট। অথচ ১০০ শয্যার বিপরীতে প্রায় তিন গুণ রোগী ভর্তি থাকে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। নানা সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালের কার্যক্রম।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হয়। ১০০ শয্যার হাসপাতালে বিশেষজ্ঞসহ মোট চিকিৎসক থাকার কথা ৪০ জন। এর বিপরীতে বর্তমানে আছেন ২০ জন। দীর্ঘদিন ধরে সিনিয়র কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজি, সার্জারি ও অবেদনবিদ নেই।
শুধু চিকিৎসক নন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদেরও সংকট আছে। সহসেবক, হিসাবরক্ষক, কার্ডিওগ্রাফার, চালকসহ তৃতীয় শ্রেণির ৪০ জন কর্মচারীর বিপরীতে আছেন ২৩ জন। অর্থাৎ ১৭টি পদ ফাঁকা। চতুর্থ শ্রেণির অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, স্ট্রেচার বহনকারী ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পদে ২৩ জন থাকার কথা, আছেন মাত্র ৬ জন।
গত বুধবার ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। চার থেকে পাঁচজন চিকিৎসক বহির্বিভাগে রোগী দেখছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে রোগীদের। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে অনেকেই মেঝেতে বসে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম আজিজার শেখ (৬০)। তিনি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার নালিয়া থেকে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তিনি বলেন, ‘জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা ও কাশির সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসছি। দুই ঘণ্টা ধরে বসে আছি এখনো সিরিয়াল পাইনি, অনেক ভিড়। আরও মনে হয় এক-দেড় ঘণ্টা লাগবে সিরিয়াল পাতি।’
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বুধবার ১০০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৯৩, যা শয্যাসংখ্যার প্রায় তিন গুণ। ওই দিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন ৬০০ জনের বেশি রোগী।
বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা দেখা যায়, পুরুষ ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যা ৩০টি। সেখানে রোগী ভর্তি আছেন ৫৭ জন। মহিলা ওয়ার্ডে ২০ শয্যা থাকলেও রোগী ভর্তি ৯১ জন। শিশু ওয়ার্ডের ভেতরে ও বারান্দা মিলিয়ে শয্যা আছে মাত্র ১৭টি। সেখানে রোগী রয়েছেন ৭৩ জন। একেকটি শয্যায় দু-তিন জন করে সেবা নিচ্ছেন। মহিলা ওয়ার্ডের বারান্দার দুই পাশে লাইন দিয়ে মেঝেতে বিছানা পেতেছেন রোগীরা। সেই লাইন চলে গেছে পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। তবুও জায়গা না পেয়ে অনেকেই চলাচলের পথের পাশে বিছানা পেতে সেবা নিচ্ছেন।
এর মধ্যে দেখা যায়, একজন নারী সন্তান নিয়ে মেঝেতে শুধু চাদর পেতে বসেছেন। জোসনা বেগম নামের ওই নারী প্রত্যন্ত গ্রাম নখখালী থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তিনি বলেন, প্রায় তিন ঘণ্টা হলো হাসপাতালে এসে এখনো একটি তোশক পাননি। চাদর বিছিয়ে বসে আছেন।
মহিলা ওয়ার্ডের ইনচার্জ জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স শাহিনুর খাতুন বলেন, প্রতিদিন রোগী থাকে শয্যাসংখ্যার প্রায় তিন গুণ, যা সামলানো তাঁদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। তারপরও তাঁরা চেষ্টা করেন সবাইকে ভালোভাবে সেবা দিতে।
হাসপাতালের শিশুরোগবিশেষজ্ঞ আলিমুজ্জামান বলেন, ‘শিশু ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যার বিপরীতে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি রোগী থাকে। আমাদের কষ্ট হলেও চেষ্টা করছি ভালো সেবা দেওয়ার।’
এদিকে হাসপাতালের শৌচাগারগুলো অপরিষ্কার, কয়েকটি ব্যবহারের অনুপযোগী। সদর উপজেলার ভাদুলিডাঙ্গার বাসিন্দা তাবাসসুম বলেন, ‘অসুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু এখানকার বাথরুমে ঢুকলেই বমি আসে, ভীষণ অপরিষ্কার। আমাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। তাই প্রয়োজন হলে বাড়িতে চলে যাচ্ছি। কিন্তু যারা অনেক দূর থেকে আসে, তাদের কিছু করার থাকে না। এসব বাথরুম দ্রুত পরিষ্কার করা উচিত।’
এ ছাড়া হাসপাতালের ভেতরে থাকা নলকূপগুলো কাজ করে না। সুপেয় পানির জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাইরে থেকে পানি কিনতে হচ্ছে তাঁদের। আয়েশা রহমান রাফী বলেন, হাসপাতালের ভেতরে থাকা নলকূপ দুটির পানি পানযোগ্য নয়। ফলে বাইরের নলকূপ থেকে সবাই পানি নেন অথবা কেনা পানি ব্যবহার করেন।
এসব সংকট নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল গফফার। এ ব্যাপারে তিনি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার (আরএমও) সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আরএমও সুজল কুমার বকশী বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের মারাত্মক জনবল–সংকট চলছে। প্রতিদিন ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ রোগী সামলাতে হয়, সেখানে জনবল অর্ধেকের কম। প্রতিটা সেক্টরেই জনবলের স্বল্পতা। এই জনবল নিয়েই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু অল্প জনবল নিয়ে আমরা যে সেবা দিতে চাই বা জনগণ যা চায়, সেটা আমরা দিতে পারছি না।’