খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামে ভদ্রা নদীর ভেঙে যাওয়া বাঁধের স্থানে রিংবাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন এলাকাবাসী। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ওই কাজে যুক্ত হয়েছেন শত শত মানুষ। কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, নারী—সবাই আছেন সেই কাতারে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন তাঁরা। চার দিন ধরে এভাবেই বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে হওয়া উচ্চ জোয়ারে দেলুটি ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ২২ নম্বর পোল্ডারের তেলিখালী গ্রামের কাছে ভদ্রা নদীর ২৫০ মিটারের মতো বাঁধ ভেঙে গেছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ এই মুহূর্তে মেরামত করা সম্ভব নয়। এ কারণে ভাঙা স্থানের একপাশে রিংবাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা ও পাউবো। রিমাল আঘাত করার রাতেই ভেঙে যায় বাঁধটি। এতে ওই এলাকার ১৩টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ২২ নম্বর পোল্ডারের আয়তন প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, পোল্ডারটি দীর্ঘদিন ধরে লোনাপানিমুক্ত ছিল। লবণপানি প্রবেশ করায় ওই এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। খাবার পানির উৎস পুকুরগুলো লোনাপানিতে ভরে গেছে। গৃহহীন হয়ে মানুষ সড়কের ওপর খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। শৌচাগারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নারীদের কষ্ট আরও বেড়েছে।
বাঁধের কাজ করা লোকজন বলেন, গতকাল বুধবার ভোর থেকে কাজ শুরু করে রিংবাঁধের প্রায় অর্ধেক নির্মাণ করা সম্ভব হয়। বেলা দেড়টার দিকে জোয়ার চলে আসায় আর কাজ করা যায়নি। পরে রাত ৮টার দিকে আবার ভাটা শুরু হলে কাজে নেমে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ সময় তিনটি খননযন্ত্র দিয়ে কাজ চলে। তাতে কোনো রকমে পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। আজ সকালের ভাটার সময় চলছে রিংবাঁধ টেকসই করার কাজ। বাঁধ টেকসই না হলে আবারও তা ভেঙে যেতে পারে।
গোপীপাগলা গ্রামের জয়ন্ত রায় বলেন, বাঁধ নির্মাণের কাজ করা হয় জোয়ার-ভাটার ওপর ভিত্তি করে। জোয়ারে পানির চাপ থাকায় কাজ করা যায় না। ভাটার সময় পানি সরে গেলে কাজ শুরু করতে হয়। আগের দিন বিকেল থেকে কখন কাজ শুরু হবে, তা জানিয়ে এলাকায় এলাকায় মাইকিং করা হয়। সেই অনুযায়ী যথাসময়ে হাজির হন শত শত মানুষ। কেউ পরিচিত, কেউবা অপরিচিত—বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তাঁরা। কাজ শুরু হলে কেউ যেন ঘরে বসে থাকতে পারেন না। কোনো এক অজানা কারণে এখানে চলে আসেন। সবাই মিলে কাজ করার আনন্দই অন্য রকম।
দেলুটি ইউনিয়নের জিরবুনিয়া গ্রাম থেকে বাঁধ নির্মাণের কাজে যোগ দিয়েছেন আবু জাফর সানা। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরা এখানে কাজ করতে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে ট্রলারে করে শত শত মানুষ এসেছেন। সবাই স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করবেন। এর বিনিময়ে কোনো কিছু পাবেন না তাঁরা।
বাঁধ নির্মাণের কাজে সহায়তা করতে প্রায় ৩০০ লোক নিয়ে গেছেন লস্কর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কে এম আরিফুজ্জামান। তিনি বলেন, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁর পাশে দাঁড়ানো সবার নৈতিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই ট্রলার ভাড়া করে ৩০০–এর বেশি মানুষ নিয়ে এসেছেন বাঁধ মেরামতের কাজে।
দেলুটি ইউপির চেয়ারম্যান রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, কয়েক দিন ধরেই রিংবাঁধ নির্মাণ করে পানি আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। গতকাল রাতেই মোটামুটি রিংবাঁধ দেওয়ার কাজ শেষ হয়েছে। তবে সকাল থেকে বাঁধ টেকসই করার কাজ চলছে। দেড় হাজারের বেশি মানুষ এই কাজে যুক্ত হয়েছেন।
দেলুটি ইউনিয়ন পড়েছে খুলনা পাউবো সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ-২–এর আওতায়। ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেলুটি ইউনিয়ন। কয়েক দিন ধরে রিংবাঁধ নির্মাণ করার কাজ চলছে। অবশেষে গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে মোটামুটি পানি আটকানো হয়েছে। ওই কাজে বাঁশ, খুঁটি, বস্তাসহ অন্য সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। শত শত মানুষ একসঙ্গে কাজ করায় কাজটি দ্রুত শেষ করা গেছে।