কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ায় মৌসুমের প্রথম লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে ৪ নভেম্বর থেকে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ৮ দিনে উপজেলার লেমশিখালী, উত্তর ধুরুং ও দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের কিছু জমিতে অন্তত ৪৫ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। ৪-৫ দিন ধরে পাশের উপজেলা পেকুয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত তিন উপজেলায় লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১২৫ মেট্রিক টন।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কুতুবদিয়ার লেমশিখালী, দক্ষিণ ধুরুং ও উত্তর ধুরুং ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, কয়েক হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। আরও কয়েক হাজার একর জমি লবণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। চাষিরা জানান, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কুতুবদিয়ার অন্তত ৭ হাজার একর জমির শতভাগে লবণ উৎপাদিত হবে। তবে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। তাতে হতাশ চাষিরা।
চাষিরা জানান, গত বছর প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ৪০০ টাকায়। এবার ব্যবসায়ীরা ১৮০ টাকার বেশিতে লবণ কিনছেন না। তাতে লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে। অথচ প্রতি মণ লবণ বিক্রির বিপরীতে চাষিদের খরচ হয় ২০০ টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলতি মৌসুমের পাঁচ মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ, সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, ঈদগাঁও, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬৯ হাজার একর জমিতে ২৬ লাখ মেট্রিক টক লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বছর ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরুর পরবর্তী ৬২ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এবার তাপমাত্রা বেশি এবং ঝড়–বৃষ্টি না হলে লবণ উৎপাদন ২৬ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারণ করা হয় ২৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
বিসিকের কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে প্রথম লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে কুতুবদিয়ায়। বলা যায়, মৌসুম শুরুর ১৫ দিন আগে। এরপর পেকুয়া ও বাঁশখালীতে। এখন ১০ শতাংশ জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে অবশিষ্ট ৯০ শতাংশ জমিতে পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু হবে। চলবে টানা পাঁচ মাস। তাপমাত্রা বেশি থাকলে লবণের বাম্পার উৎপাদন হতে পারে। মৌসুমে দৈনিক ৪৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল গত বছর মার্চে। তবে একবার বৃষ্টি হলে টানা পাঁচ থেকে সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে।
বিসিকের তথ্যমতে, গত বছর ৬৮ হাজার একরের বেশি জমিতে আধুনিক পলিথিন প্রযুক্তি পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়েছে। এবারও শতভাগ জমিতে পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদিত হবে। এ বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন আড়াই গুণ বেশি হয়। জেলার ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
শুরুতেই লোকসান
গতকাল দুপুরে কুতুবদিয়ার দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সিকদারপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, কয়েক শ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। আরও এক হাজার একর জমি শ্রমিকেরা লবণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করছেন। প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়।
টানা ২০ বছরে লবণ উৎপাদন করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী সাদেকুল ইসলাম। গত বছর ৩ একর জমিতে তিনি লবণ চাষ করেন। প্রতি মণ লবণ বিক্রি করেন ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। এ বছরও তিনি ৩ একরে লবণ উৎপাদন শুরু করেন। কিন্তু দাম ১৮০ টাকা হওয়ায় তিনি চরম হতাশ।
ঘটনাস্থলে সাদেকুল ইসলাম (৪৩) প্রথম আলোকে বলেন, গত ১০ বছরে লবণের দাম ১৮০ টাকায় নামেনি কখনো। অথচ রহস্যজনক কারণে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা লবণ উৎপাদনের শুরুতে দাম কমিয়ে দেওয়ায় চাষিদের লবণ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, যাতে লবণসংকট দেখিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা যায়। লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করতে হচ্ছে দেখে বহু চাষি জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। তাতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাশের লবণ চাষি রুহুল আমিন সিকদার বলেন, গত বছর লবণ উৎপাদনের শুরুতে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা। এবার বেশি লাভের আশায় চাষিরা আগেভাগে মাঠে নেমে লবণ উৎপাদন শুরু করেন। কিন্তু লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি চাষিদের মারাত্মকভাবে হতাশ করছে। মাঠে প্রতি কেজি লবণের দাম ৪ টাকার বেশি হলেও বাজারে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৬০ টাকায়। মাঠ থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত লবণের দামের এত তারতম্য কেন, তা তদারকি কিংবা অনুসন্ধানের কেউ নেই।
বিসিকের তথ্যমতে, বর্তমানে কুতুবদিয়ায় ৭ হাজার একর, টেকনাফে ৪ হাজার ৪২১ একর, মহেশখালীতে ১৫ হাজার একর, পেকুয়ায় ১০ হাজার একর, চকরিয়ায় ১১ হাজার একর, ঈদগাঁয় ৫ হাজার একর, কক্সবাজার সদরে ৩ হাজার ৯০০ একর এবং বাঁশখালীতে ৭ হাজার একর ও পটিয়াতে ১ হাজার ৮৫০ একর মাঠে লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, মৌসুম শুরুর মুহূর্তে লবণের দাম কমে যাওয়ায় চাষিরা হতাশায় ভুগছেন। আর্থিক লোকসানের কারণে চাষের পরিমাণ কমে গেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। লবণের দাম কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।