সুনামগঞ্জ সদরের টুকেরবাজার থেকে ১৯ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে গাছগুলো কাটতে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের দুই পাশে সারি সারি নানা জাতের গাছ। গাছগুলোর বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। সবুজে মোড়া হাজারো গাছের ছায়ায় পথ চলেন পথচারীরা, পাখিরা নেয় আশ্রয়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই ‘সামাজিক বনায়ন বিধির’ দোহাই দিয়ে প্রায় তিন হাজার বৃক্ষনিধনের আয়োজন চলছে সড়কটিতে। প্রতিটি গাছের গায়ে লাল কালিতে দেওয়া হয়েছে নম্বর। এ যেন একেকটি গাছের মৃত্যু পরোয়ানা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার টুকেরবাজার থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার পর্যন্ত সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের দুই পাশে লাগানো বৃক্ষনিধনের প্রস্তুতি চলছে। ইতিমধ্যে গাছ বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে বন বিভাগ। আগামী ১ এপ্রিল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। স্থানীয় লোকজন জানেন, গাছগুলো গণনার জন্য নম্বর দেওয়া হয়েছে। কাটার কথা শুনে অনেকেই বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এক সড়কে এত গাছ কাটার বিষয়ে কোনো কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিক। যদিও সড়কটি তাঁদের আওতাধীন। বন বিভাগের ভাষ্য, এসব গাছ সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে লাগানো হয়েছিল। কাটার সময় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী এখন এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ সদর থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার পর্যন্ত সড়কের দূরত্ব ১৯ কিলোমিটার। সওজের আওতাধীন সড়কটি ২০২২ সালের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত বছরের জুনে সড়কটি সংস্কার হয়। তখন সওজের পক্ষ থেকে সড়ক সংস্কারের সময় যেসব গাছের গুঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বন বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওই গাছগুলো সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে রোপণ করা হয়েছিল। স্থানীয় লোকজন গাছের পরিচর্যা করেন। এখন মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার সুরমা নদীর আবদুজ জহুর সেতু থেকে টুকেরবাজার পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে তেমন গাছ নেই। টুকেরবাজার থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিয়ামতপুর হয়ে সড়কটি জামালগঞ্জের সাচনাবাজার পর্যন্ত গেছে। সড়কের বেশির ভাগ অংশ সদরে। দুই পাশে সারি সারি গাছ। টুকেরবাজার থেকে গাছে নম্বর দেওয়া শুরু হয়েছে। সদরের উমেদশ্রী, নিধিরচর, ইচ্ছারচর, ইসলামপুর, বেড়াজালি, আহমদাবাদ; বিশ্বম্ভরপুরের দুলবারচর, সংগ্রামপুর এবং জামালগঞ্জের শেরমস্তপুর, নজাতপুর থেকে সাচনাবাজার পর্যন্ত প্রতিটি গাছে নম্বর দেওয়া।
নিয়ামতপুর সেতুর পাশে স্থানীয় দুজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। গাছ কাটার বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না। একজন বলেন, এলাকার লোকজনকে নিয়ে বছর বিশেক আগে গাছগুলো লাগানো হয়। কিছু লোক বন বিভাগের কমিটিতে আছেন। অন্যজন বলেন, ‘সব গাছ কাটলে তো রাস্তা ন্যাড়া অইজিব। ইলাগাছ কাটা ঠিক অইত না।’
জামালগঞ্জের নজাতপুর গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন একটি কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, গাছ লাগানোর পর তাঁরা দেখেশুনে রেখেছেন। এ জন্য তাঁদের সঙ্গে লিখিত চুক্তিও আছে। গাছ বিক্রি হলে তাঁরা কিছু টাকা পাবেন। গাছ কাটা প্রয়োজন কি না, জানতে চাইলে নিজাম বলেন, ‘তারা তো (বন বিভাগ) খইছে, কাটার সময় অইগিছে। পরে আবার লাগাইব।’
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক বনায়ন বিধিমালা-২০০৪ অনুযায়ী, গাছ বিক্রির টাকা উপকারভোগী ৫৫ ভাগ, বন অধিদপ্তর ১০ ভাগ, ভূমির মালিক হিসেবে সওজ ২০ ভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ৫ ভাগ পাবে। বাকি ১০ ভাগ টাকা দিয়ে আবার বনায়ন করা হবে।
বন বিভাগের সুনামগঞ্জ রেঞ্জ কর্মকর্তা (ফরেস্টার) মো. দ্বীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গাছগুলো সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে লাগানো হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা গাছের পরিচর্যা করেছেন। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তাঁরাই গাছ কাটতে তাগাদা দিচ্ছেন। এ জন্য বিভাগীয় কার্যালয় থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পরে আবার সড়কের দুই পাশে গাছ লাগানো হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান গাছ কাটার কথা শুনে বিস্মিত। তিনি বলেন, ‘এত গাছ কাটবে কেন? পরে আবার লাগানোর চেয়ে এগুলো কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেই পথ খোঁজা উচিত। প্রশাসন স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরাও থাকব। প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষদের সরকার অন্যভাবে সুবিধা দিক। তবু হাজার হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ বন্ধ করা দরকার।’
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, গাছ কাটার জন্য যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে। একটি গাছ ঘিরে একটি জীবন চক্র গড়ে ওঠে। গাছ কাটা মানে সব শেষ। সামাজিক বনায়নের বিধিমালার পরিবর্তন দরকার। একটি সড়কের সব গাছ কেটে ফেলা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। নতুন করে গাছ লাগিয়ে এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না।