জন্মদিনের কেক কাটা নিয়ে শিক্ষকের পিটুনিতে ছাত্রের মৃত্যুর অভিযোগ, স্কুলে ভাঙচুর

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে ছাত্রের মৃত্যুর খবরে বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রোববার বিকেলে
ছবি: সংগৃহীত

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে শিক্ষকদের মারধরে নবম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহত ছাত্রের পরিবারের সদস্য ও একাধিক শিক্ষার্থীর ভাষ্য, স্কুলে জন্মদিনের কেক কাটা নিয়ে এক শিক্ষক ওই ছাত্রের বুকে হাঁটু দিয়ে আঘাত করেন। পরে সে বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক ওই ছাত্রকে মৃত ঘোষণা করে।

অপর দিকে শিক্ষকদের দাবি, স্কুল থেকে বাড়ি গিয়ে ওই ছাত্র বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে। এ ঘটনায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ চার শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।

আজ রোববার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া ওই ছাত্রের নাম রাজপ্রতাপ দাস। সে কালীগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমুলিয়া চণ্ডীপুর গ্রামের দীনবন্ধু দাসের ছেলে। সে নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল।

ওই ছাত্রের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। স্থানীয় লোকজন বিদ্যালয়ের কয়েকটি কক্ষের আসবাব ও ১০-১২টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন। পরে তাঁরা তিন-চারটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

রাজপ্রতাপের এক সহপাঠী বলে, আজ তার ও এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে সকাল ১০টার দিকে বিদ্যালয়ের একটি তিনতলা ভবনের একটি ফাঁকা কক্ষে রাজপ্রতাপসহ কয়েক বন্ধু মিলে জন্মদিনের কেক কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এ মুহিতের সঙ্গে সেখানে আসেন অবকাশ চন্দ্র খাঁ, মনিরুল ইসলাম, সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরীসহ পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক। শিক্ষকেরা তাকে ও তার সহপাঠীদের এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন। রাজপ্রতাপের বুকে একজন শিক্ষক হাঁটু দিয়ে আঘাত করেন। পরে রাজপ্রতাপ ও তাকেসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। বিদ্যালয়ে জন্মদিন পালন করা হচ্ছে কেন—বলে তাদের আবারও চড়–থাপ্পড় মারা হয়। এ সময় রাজপ্রতাপ ও সে প্রধান শিক্ষকের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তিনিও তাদের আবার চড়–থাপ্পড় মেরে সরিয়ে দেন।

রাজপ্রতাপ দাস

রাজপ্রতাপের ওই সহপাঠী আরও বলে, এসব ঘটনার পর তারা শহীদ মিনারের ওপর বসে ছিল। এ সময় রাজপ্রতাপ বলে, তার শরীর খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা করছে, বমি বমি ভাব হচ্ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে। একপর্যায়ে রাজপ্রতাপ বাড়ি চলে যায়। এর ২০-২৫ মিনিট পরে সে শোনে, রাজপ্রতাপ মারা গেছে।

রাজপ্রতাপের কাকিমা তাপসী রানী দাস বলেন, রাজপ্রতাপ অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি এসে বলে তার বুকে ব্যথা করছে। বমি করতে থাকে। দ্রুত তাকে নলতা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নলতা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবুল ফজল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই ছাত্রকে যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন সে মৃত ছিল। প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হয়নি সে আত্মহত্যা করেছে।

ছাত্রের মৃত্যুর খবর শুনে শত শত মানুষ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করে

অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক অবকাশ চন্দ্র খাঁ বলেন, বিদ্যালয় শুরুর সময় রাজপ্রতাপসহ ১০-১২ ছেলেমেয়ে তিনতলার একটি কক্ষে জন্মদিনের কেক কাটছিল। তারা কয়েকজন শিক্ষক গিয়ে তাদের এ ধরনের আয়োজন করতে নিষেধ করেন। কথা না শোনায় রাজপ্রতাপকে তিনি দুটি চড় মেরেছিলেন। তবে অন্য শিক্ষকেরাও রাজপ্রতাপ ও কয়েকজন ছাত্রকে মারধর করেন। চারজন ছাত্রকে তাঁরা ধরে প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যান। প্রধান শিক্ষক তাঁদের তিরস্কার করেন। পরে তারা চলে যায়।

নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল মোনায়েম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকেরা রাজপ্রতাপসহ চারজনকে তাঁর কক্ষে ধরে নিয়ে আসেন। এ সময় রাজপ্রতাপ তাঁর পায়ে ধরে মাফ চাইতে যায়। কিন্তু তাঁর (প্রধান শিক্ষক) পায়ে আঘাত থাকায় রাজপ্রতাপকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের বকাঝকা করা হয়েছে। তবে কাউকে মারধর করা হয়নি। ওই চার ছাত্রের অভিভাবকের কাছে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে কেউ ধরেনি। শুধু রাজপ্রতাপের কাকা দেবীরজ্ঞন দাস মুঠোফোন ধরেন। দেবীরজ্ঞন দাসকে বিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে এসে রাজপ্রতাপকে তার কাছে তুলে দেওয়া হয়। এসব ঘটনার দুই-তিন ঘণ্টা পর শুনেছেন, রাজপ্রতাপ মারা গেছে। স্কুলের এসব ঘটনায় রাজপ্রতাপ বাড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে মনে হচ্ছে তাঁর।

স্থানীয় লোকজন বলেন, রোববার বিকেল ৪টার দিকে রাজপ্রতাপের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর সহপাঠীসহ এলাকাবাসী বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে স্কুল চত্বরে ফিরে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় কয়েক শ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা প্রধান শিক্ষকের কক্ষসহ কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর করেন। ১০-১২টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন এবং তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন। খবর পেয়ে কালীগঞ্জ থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন রহমান জানান, কী কারণে স্কুলছাত্র মারা গেছে, তা ময়নাতদন্ত ছাড়া বলা যাচ্ছে না। তবে প্রাথমিকভাবে বিষ খাওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুর রহমান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রধান শিক্ষক আবদুল মোনায়েম, অবকাশ চন্দ্র খাঁ, মনিরুল ইসলামসহ চার শিক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কালীগঞ্জ থানায় নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় রাত ১০টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।