রহিমা খাতুনের কান্না থামছে না। কখনো ছেলেকে, কখনো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। আবার কখনো মাটির ঘরের বারান্দায় বসে তাকিয়ে থাকছেন সামনের দিকে। প্রিয়জনকে হারানোর শোক আর সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে, সে দুশ্চিন্তা তাঁর চোখে। সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য যাওয়ার আগে মনিরুজ্জামান বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সে বিদায় যে শেষবিদায় হবে তা কল্পনায়ও আনেননি রহিমা।
গত শুক্রবার বিকেলে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘের আক্রমণে নিহত হন রহিমা খাতুনের স্বামী মো. মনিরুজ্জামান বাচ্চু (৪৮)। তাঁদের বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলে পরিচিত গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামে।
মনিরুজ্জামান ৩০ বছর ধরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করতেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল। প্রতিবছর ১ এপ্রিল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ শুরু হয়। চলে দুই মাস। রোজা ও ঈদের কারণে এবার ১ এপ্রিল মনিরুজ্জামান সুন্দরবনে যাননি। ঈদের পর ১৬ এপ্রিল সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন থেকে পাস (অনুমতি) নিয়ে দুই সপ্তাহের জন্য মধু সংগ্রহ করতে যান সুন্দরবনে। যাওয়ার আগে বাড়িতে বাজার করে রেখে গিয়েছিলেন। প্রথা অনুযায়ী আপনজনদের কাছ থেকে বিদায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
মনিরুজ্জামান যে দলের সঙ্গে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন, সে দলের নেতা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের বিল্লাল কয়াল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার বিকেলে আসরের নামাজের পরে দোবেকি ক্যাম্পের কাঁচিকাটা নদীর ভারতের সীমান্তসংলগ্ন ফুলখালী এলাকায় মধু আহরণ করছিলেন তাঁরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একটি হিংস্র বাঘ মনিরুজ্জামানের ওপর হামলে পড়ে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে গহিন জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। পরে সবাই মিলে লাঠিসোঁটা নিয়ে পাল্টা হামলা করলে বাঘটি মনিরুজ্জামানের ছিন্নভিন্ন দেহ ফেলে সটকে পড়ে। এরপর তাঁরা মরদেহ উদ্ধার করে শনিবার দুপুর ১২টার দিকে তাঁর গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়ার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসেন।
মনিরুজ্জামানের স্ত্রী রহিমা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাগের নুন আনতে পান্তা থ্যাকে না। সম্বল বলতি পাঁচ কাঠা জমিতে মাটির একখান ঘর। স্বামীর রোজগারে সুংসার চলত। এখন চারটি ছ্যালে-মাইয়ে নিয়ে কী করব, কোথায় দাঁড়াবে কতে পারো তুমরা? মহাজনের কাছে অনেক দেনা নইছে। বাঁচি থাকতি পারি কি না ঠিক নেই, তা ক্যামনে শোধ দেব?’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘আপনি বাঘ–বিধবাদের বাঁচান। আপনি পাশে না দাঁড়ালে কেউ দাঁড়াবে না।’
বাঘ–বিধবাদের নিয়ে কাজ করেন বেসরকারি সংস্থা প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সালে মে পর্যন্ত ১২ বছরে সুন্দরবনে বিশেষ করে মধু আহরণ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজার ১৮২ জন। পরবর্তী ১২ বছরে কয়েকজন বাঘের হামলায় আহত হলেও কেউ প্রাণ হারাননি। তিনি বলেন, বাঘের হামলায় যারা প্রাণ হারান তাঁদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা চরম অভাব–অনটনে দিন কাটান। কষ্টের শেষ থাকে না।
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, গত পাঁচ–সাত বছরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘের হামলায় নিহত হওয়ার কোনো তথ্য নেই তাঁদের কাছে। মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাঘের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি কোথায় বাঘের হামলার শিকার হয়েছেন তা তদন্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের মধ্যে হামলার শিকার হলে তিনি সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ পাবেন।