ঢোল কাঁধে শাহিনুর কোথাও গেলে মুহূর্তে তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হয় জটলা। তখন শাহিনুর ঢোল বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করেন। খালি গলায় মধুর সুরে তাঁর গান শুনে প্রাণ জুড়ায় হাঁটুরে মানুষেরা।
সম্প্রতি এমন এক জটলা দেখা যায়, রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী হাটে। সেখান থেকে ঢোলের তালে তালে মধুর সুরে কানে ভেসে আসছে গান—‘মনোরে... ধান্দাবাজির ধোঁকায় পড়ে/দুকলা বাজির ধোঁকায় পড়ে/বেসুরে বাজাইলি তাল/ঘুম দিয়া কাটাইলি রে মন চিরকাল/বনের পশু কোরবানি করে নাম ফলাইলি মুসলমান/একটুকরা মাংসের জন্য কান্দে গরিব পোলাপান/মাংস ফ্রিজে রাইখা খায় বছর ঘুরাইয়া/পাপে ভরা দেহখানি বিচার হবে কেয়ামতকাল/ঘুম দিয়া কাটাইলিরে মন চিরকাল...’
ভিড় ঠেলে এগোতে দেখা মেলে শাহিনুরের। পুরো নাম শাহিনুর ইসলাম শাহিন। জন্ম থেকে অন্ধ শাহিনুর ভিক্ষা না করে মানুষকে গান শুনিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। বিভিন্ন বাজার, বাসস্ট্যান্ড, পাড়ার মোড়ে গান করে দিন চলে তাঁর। নির্বাচন বা অন্য কোনো প্রচারের সময় শাহিনুরের কদর বেড়ে যায়।
গানের পসরায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কথা শুনে বোঝা যায়, শাহিনুর তাঁদের সুপরিচিত। তাই সবাই আপনমনে তাঁর গান শুনছিলেন। গান শুনে শ্রোতারা খুশি হয়ে শাহিনুরের হাতে যা দেন, তাতেই তাঁর সংসারের খরচ চলে।
শাহিনুর বলেন, রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। ১৫ বছর আগে বিয়ে করেন। চোখে না দেখায় কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই বিয়ের পর জীবিকা হিসেবে গান গাওয়াকে বেছে নেন। তাঁর এক মেয়ে শারমিন আক্তার (১৩) স্থানীয় বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ও ছেলে শামীম ইসলাম (১০) তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সহায়সম্বল বলতে ৩ শতাংশ জমি ও টিনের একটি ভাঙাচোরা ঘর। প্রতিদিন গান গেয়ে যে তিন থেকে চার শ টাকা আয় করেন, তা দিয়েই চলে তাঁর সংসার।
ইকরচালী বাজারের ব্যবসায়ী আনছারুল ইসলাম বলেন, ‘অন্ধ হলে কী হবে, শাহিনুরের কথায় অনেক আলো পাই। তিনি আধ্যাত্মিক ধরনের গান করেন। তাঁর গানের কথা জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। আমরা তাঁর গান শুনে খুশি হয়ে দুই চার টাকা করে দিই। আশপাশের হাট–বাজারে এমন কেউ নেই যে অন্ধ শাহিনুরের গান শোনেননি বা তাঁকে নেন না।’
ওই হাটে বাজার করতে আসা ছুট মেনানগর গ্রামের দিনমজুর সাদেকুল ইসলাম বলেন, ‘শাহিনুর গান শুনিয়ে টাকা নেন। অন্ধ হয়েও ভিক্ষা করেন না। মানুষ তাঁকে এমনি টাকা দিলেও তিনি নেন না। মানুষ তাঁর গানকে ভালোবেসে শোনেন। হাটে এসে যদি শুনি, অন্ধ শাহিনুর এসেছে, তাহলে তাঁর গান শুনেই বাড়ি ফিরি। তাঁর গানে প্রাণ জুড়ায়, মনে প্রশান্তি আসে। তিনি নিজের মনের কথা দিয়েও অনেক গান বানান। সেগুলো শুনে আমরা বিনিময়ে তাঁকে পাঁচ-ছয় টাকা করে দিই।’
শাহিনুরের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপ চলে দীর্ঘক্ষণ। একপর্যায়ে তিনি একটানে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ শুধু চোখে দৃষ্টিশক্তিটুকু দেননি। একজন মানুষ হিসেবে এটিই আমার কমতি। চোখে না দেখার জন্য ভারী কাজ করতে পারি না। সহায়সম্বলও আমার নেই। এ অবস্থায় আমার আয়ের পথ ভিক্ষা করা। কিন্তু আমি ভিক্ষা করা পছন্দ করি না। গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে যা আয় করছি, তা দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। যতদিন বাঁচব মানুষকে গান শুনিয়ে, আনন্দ দিয়ে যা রোজগার হবে তা দিয়েই জীবন চালাব।’
শাহিনুর প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তবে তা সংসার চালানোর মতো সহায়ক নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাজারের সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। যে টাকা ভাতা পাই, তা দিয়ে পাঁচ দিনের সংসার খরচও চলে না। থাকার ঘরটা নড়বড়ে, কখন জানি উল্টে যায়। আমার তিন শতক জায়গায় যদি সরকার একটা আশ্রয়ণ ঘর করে দিত খুব উপকার হতো।’