২৫০ শয্যার নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বারান্দায় ও মেঝেতে ঠাঁই নিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের। ছবিটি সোমবার দুপুরে তোলা
২৫০ শয্যার নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বারান্দায় ও মেঝেতে ঠাঁই নিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হচ্ছে রোগীদের। ছবিটি সোমবার দুপুরে তোলা

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে একবেলা

‘মোর অসুখ। জ্বর সারেছে না, গাওত ব্যথা। কয়দিন থাকি বারান্দাত আছো, ভিতরত বিছানা খালি নাই। ওমরা কইছে বিছানা খালি হইলে দিবে।’ ২৫০ শয্যার নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে মহিলা ওয়ার্ডের বারান্দায় শুয়ে সোমবার দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব ন্যানো বালা। তিন দিন ধরে হাসপাতালটিতে এভাবে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন কচুকাটা ইউনিয়নের দুহুলী গ্রামের এই বাসিন্দা। তবু ওয়ার্ডে রোগীর জন্য নির্ধারিত বিছানায় তাঁর জায়গা হয়নি।
 
ন্যানো বালার মতো আরও ১০ রোগী একই ওয়ার্ডের বারান্দায় বিছানা পেতে ঠাঁই নিয়েছেন। হাসপাতালটিতে শয্যাসংকটের কারণে ওয়ার্ড ও বারান্দার মেঝেতে সামান্য জায়গা খুঁজে নিয়ে দিনের পর দিন সেখানে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন অনেক রোগী। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগীর সেবা দিতে হিমশিম দশায় পড়েছেন নার্সরা। রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা বলছেন, বিছানা না পেয়ে এভাবে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।

ওই ওয়ার্ডের মেঝেতে দেখা গেল মর্জিনা বেগমকে (৬০)। তিনি চিকিৎসা নিতে এসেছেন জেলা সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের সিংদই গ্রাম থেকে। তিনি বলেন, ‘মোর জ্বর, মাথাঘুরা আর শ্বাসকষ্ঠ। বিছানা নাই, এই জন্য মাটিতে (মেঝেতে) থাকির দিছে। কষ্ট হইলেও করির কিছু নাই, চিকিৎসা নিবার জইন্য থাকির নাগেছে।’

অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্য না থাকায় অনেক রোগীকেই এমন দুর্ভোগ সয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। তবে কেউ কেউ হাসপাতালের এমন পরিবেশে থাকতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালে ছুটে যান। শ্বাসকষ্ঠ ও জ্বর নিয়ে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি হন শহরের সওদাগরপাড়ার জান্নাতুল ফেরদৌস। কিন্তু বিছানা না পাওয়ায় অন্য রোগীর বিছানার পাশে বসে নেবুলাইজ করেন তিনি। পরে ভর্তি বাতিল করে হাসপাতাল ছেড়ে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চলে যান। যাওয়ার আগে তিনি বলেন, ‘এখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় এখানে থাকলে আমি আরও বেশি অসুস্থ হব। তাই ক্লিনিকে যাচ্ছি।’

জায়গা না পেয়ে অনেক রোগীই হাসপাতালের বারান্দায় বিছানা পেতে ঠাঁই নেন। গতকাল দুপুরে তোলা

মহিলা ওয়ার্ডের কর্তব্যরত নার্সরা বলেন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত ২৫ শয্যার ওই ওয়ার্ডে মোট ১২৩ রোগী ভর্তি ছিলেন। বিছানায় সংকুলান না হওয়ায় রোগীদের মেঝেতে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে। এতে সেবা দিতে তাঁদেরও ভোগান্তি হচ্ছে।
এ সময় হাসপাতালটির অন্যান্য ওয়ার্ডেও একই চিত্র দেখা গেছে। পুরুষ ওয়ার্ডে ২৫ শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছেন ৮০ রোগী; ১৭ শয্যার শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ৩৮ শিশু; ১৯ শয্যার প্রসূতি বিভাগে ভর্তি আছেন ২৪ জন এবং ১০ শয্যার নবজাতক ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ১৮ শিশু। সার্জারি, ডায়রিয়াসহ প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে আসনসংখ্যার চার থেকে পাঁচ গুণ রোগী ভর্তি আছেন।

হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার আনোয়ারা খাতুন বলেন, ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে এখন ১৫০টি বিছানা আছে। অতিরিক্ত রোগীদের চাঁদর, কম্বল কিংবা খাট নেই। এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ৯ জুন রোববার হাসপাতালে মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৩৮ জন। একইভাবে আগের দিন গত শনিবার ৩৮৩, শুক্রবার ৩৫১, বৃহস্পতিবার ২৯২, বুধবার ৩৫০, মঙ্গলবার ৩৬২ এবং সোমবার ৩০৯ জন রোগী ভর্ভি ছিলেন।

নতুন ভবনে হাসপাতালের কিছু কার্যক্রম চালু করা হলেও সেখানে রোগী স্থানান্তর করা যায়নি। ফলে পুরোনো ভবনে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবনটিতে আসবাব ও যন্ত্রপাতি স্থাপন না করায় সেখানে রোগী নেওয়া যাচ্ছে না।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র বলছে, ১০০ শয্যার নীলফামারী আধুনিক সদর হাসপাতালটি ২০১১ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই ৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫০ শয্যার সম্প্রসারিত ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। আটতলা ভিত্তির ভবনটির ছয়তলার নির্মাণকাজে সময় লাগে প্রায় ছয় বছর। নির্মাণকাজ শেষে ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ভবনটি হস্তান্তর করে গণপূর্ত বিভাগ। বর্তমানে এটির সপ্তম তলায় কাজ চলমান আছে। অষ্টম তলার বরাদ্দ হলে সেখানে ৪০টি কেবিন হবে। সপ্তম তলায় থাকবে ৩টি ইউনিট। এর মধ্যে ১০ শয্যার আইসিইউ, ২০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড ও ১০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস বিছানা রাখার পরিকল্পনা আছে।

হাসপাতাল–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ওই ভবনে হাসপাতালের কিছু কার্যক্রম চালু করা হলেও সেখানে রোগী স্থানান্তর করা যায়নি। ফলে পুরোনো ভবনে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন ভবনটিতে আসবাব ও যন্ত্রপাতি স্থাপন না করায় সেখানে রোগী নেওয়া যাচ্ছে না।

আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আমরা সেখানে রোগীর ওয়ার্ড চালু করতে পারব। তখন পুরোনো ভবনে ১৭০টি এবং নতুন ভবনে ৮০টি বেড চালু করা হবে। তাতে কিছুটা হলেও সমস্যা কমবে।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু আল হাজ্জাজ

এসব বিষয়ে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু আল হাজ্জাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ভবনের হস্তান্তরের কিছুদিন পর করোনা মহামারি শুরু হয়। তখন আমরা ওই ভবনে সাধারণ রোগীদের না নিয়ে আইসোলেশন সেন্টার করি। এখন আমরা নতুন ভবনে জরুরি বিভাগ, ফার্মেসি, টিকিট কাউন্টারসহ কয়েকটি বিভাগ চালু করেছি।’

প্রয়োজনীয় বিছানাসহ আসবাব ও যন্ত্রপাতি স্থাপন না হওয়ায় সেখানে রোগী নেওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে আবু আল হাজ্জাজ বলেন, ‘আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে আমরা সেখানে রোগীর ওয়ার্ড চালু করতে পারব। তখন পুরোনো ভবনে ১৭০টি এবং নতুন ভবনে ৮০টি বেড চালু করা হবে। তাতে কিছুটা হলেও সমস্যা কমবে।’

হাসপাতালটির অন্তর্বিভাগের পাশাপাশি বহির্বিভাগেও রোগীর চাপ বেশি বলে জানান তত্ত্বাবধায়ক আবু আল হাজ্জাজ। তিনি বলেন, বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার রোগী দেখতে হয়। জরুরি বিভাগেও প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। অথচ ৫৮ চিকিৎসকের পদে হাসপাতালে কর্মরত আছেন ২৮ জন চিকিৎসক।