‘এব্যারক্যা কাউয়ো ইলিপও দ্যায় নাই’

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ত্রাণের আশায় দাঁড়িয়ে বন্যাদুর্গত এলাকার নারী–পুরুষ। শুক্রবার দুপুরে গাইবান্ধা সদরের কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে সারি সারি টিনশেড ঘর। দুই-তিন দিন আগে পানি নেমেছে। মেঝের কাদা শুকায়নি। আসবাবে পানির দাগ। এসব ঘরবাড়ি গোঘাট গ্রামের মধ্যে পড়েছে। গ্রামটি গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নে। আজ শুক্রবার দুপুরে নৌকা থেকে তীরে নামতেই এগিয়ে এলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী, নাম মালতী রানী। তিনি এই গ্রামে একটি ছোট্ট দোচালা টিনশেড ঘরে থাকেন। নদের তীরে দাঁড়িয়ে তিনি বন্যায় তাঁর ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিন-চার দফায় তাঁদের বসতভিটা নদীতে চলে গেছে। কয়েক বছর ধরে তিনি এখানে থাকছেন। স্বামী কালিপদ চন্দ্র পেশায় কাঠমিস্ত্রি। চারজনের সংসার। মালতী বললেন, ‘বানের মধ্যে মিস্ত্রির কাম বন্ধ। দেনা করি চলব্যার নাগচি। একনো ইলিপ (ত্রাণ) পাই নাই।’

মালতীর দুর্ভোগের কথা শোনার সময় মুহূর্তের মধ্যে সেখানে জড়ো হলেন ১৬-২০ নারী-পুরুষ। ভিড় ঠেলে সামনে এলেন ষাটোর্ধ্ব আয়শা বেগম। তিনি বলেন, ‘হামার নাম না দেন, হামার অসুস্থ সোয়ামির নামট্যা নেকি নেও। তায় তিন বচর থাকি বিচানাত পড়ি আচে। দুই বেটিক বিয়া দিচি। এ্যাকনা বেটা আচিল। তাই বউছোল নিয়া ঢাকাত থাকে। বেটা হামাক ট্যাকা পয়সা দ্যায় না। এব্যারক্যা কাউয়ো ইলিপও দ্যায় নাই।’ বৃষ্টি রানী নামের এক নারীও বলেন, ‘হামার নামটাও নেকি নেন। বানের সমায় ইলিপ পাই নাই।’

মালতী, আয়শা, বৃষ্টি রানীর মতো বন্যাদুর্গত ওই গ্রামের ত্রাণ না পাওয়া অন্তত ২২ জন এই প্রতিবেদককে সরকারি লোক ভেবে তাঁদের নাম লেখার আকুতি জানালেন। তাঁদের ধারণা, নাম লিখলে ত্রাণ পাওয়া যাবে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁরা নাম লিখতে অনুরোধ করতে থাকেন।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কামারজানি ইউনিয়নটি অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র নদ ইউনিয়নের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। মোট ছয়টি গ্রামের চারটি নদীর ওপারে অবস্থিত। পশ্চিম পাড়ে মাত্র দুটি গ্রাম। এগুলো হচ্ছে গোঘাট ও কড়ইবাড়ি। ওপারের চারটি গ্রাম হচ্ছে বাটকামারি, পারদিয়ারা, কুন্দেরপাড়া ও খারজানি। প্রতিবছর ভাঙনে ইউনিয়নের অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হচ্ছেন। এমনিতে নিত্যপণ্যের বাজার চড়া, তার ওপর বন্যায় তাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গোঘাট গ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সারি সারি নৌকা। মাঝিরা যাত্রীর অপেক্ষায় বসে আছেন। ওপারে চরাঞ্চলে বাটকামারি, পারদিয়ারা, কুন্দেরপাড়া ও খারজানি গ্রামের ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। ঘরের মেঝের কাদা শুকায়নি। আসবাবপত্রের গোড়ায় পানির দাগ লেগে আছে। অনেক ঘরের ভেতর কাদামাটি ও জলাবদ্ধতা রয়েছে। এসব গ্রামে নৌকা কিংবা অপরিচিত মানুষ দেখলেই বন্যাদুর্গতরা ত্রাণের আশায় এগিয়ে আসেন। সবার চোখেমুখে হতাশা। সবাই অসহায়। অনেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করছেন।

গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। শুক্রবার দুপুরে বন্যাদুর্গত কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামে

এলাকাবাসী জানান, সরকার ত্রাণ দিচ্ছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। যে পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে, সে পরিমাণে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে না। গোঘাট গ্রামের সুবিতা রানী (৪০) বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতাম। কিন্তু এখন বন্যার কারণে কেউ ঝিয়ের কাজে নেয় না। বেকার হয়ে পড়ে আছি। ধারদেনা করে চলছি। কাজ শুরু হলে পরিশোধ করব। আর চলতে পারছি না। কোনো ত্রাণ বা চাল পাচ্ছি না।’
কড়ইবাড়ি গ্রামের দিনমজুর চান মিয়া (৪৫) বলেন, ‘হামরা নদীর পাড়ের মানুষ। নদীত পানি বাড়লে হামারঘরে ঘরবাড়ি ডুবি যায়। বান আসি অবস্থা আরও খারাপ হচে। বানের পানিত ঘরের বেড়া নষ্ট হচে। উঁচা জাগাত যাই নাই। কষ্ট করি পানির মধ্যে আচিলাম। বানের মধ্যে কোনো ইলিপ পানো না।’ একই গ্রামের দিনমজুর শফিকুল ইসলাম (৫০) বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চাই না। সরকার আমাদের কাজ দিক। আমরা পরিশ্রম করে খাব। বন্যার সময় কাজ নাই। ত্রাণও পাচ্ছি না। চেয়ারম্যানের কাছে গেলে তিনি বলেন, যেটুকু ত্রাণ পেয়েছেন, তা বিতরণ করেছেন। আর ত্রাণ নেই।’

এদিকে চাহিদা অনুয়ায়ী ত্রাণ বরাদ্দ পাননি বলে জানিয়েছেন কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘ইউনিয়নটিতে মোট লোকসংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার। এর মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ অভাবী, অর্থাৎ ২২ হাজারের বেশি। নদী ভাঙনের কারণে এ ইউনিয়নে অভাবী লোকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ পাইনি। এ পর্যন্ত ৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি, যা প্রতিজনকে ১০ কেজি করে ৯০০ জনের মধ্যে বিতরণ করেছি। এ ছাড়া ৩৭০ জনকে শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হাতে কোনো ত্রাণ নেই। তাই দিতে পারছি না। বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে ত্রাণ চাওয়া হয়েছে। আরও ত্রাণ দেওয়া হবে বলে প্রশাসন আশ্বস্ত করেছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি ইউনিয়নে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে কামারজানি, মোল্লারচরসহ যেসব ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেগুলোতে বেশি পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত কামারজানি ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ সরকারি-বেসরকারি ত্রাণসহায়তা পেয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলোতে আরও ত্রাণ দেওয়া হবে।

নদ-নদীর পানি কমছে, তবে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ওপরে

গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। আজ বেলা তিনটা থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া ও তিস্তার পানি হ্রাস পেয়েছে। তবে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। অন্য সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখঘাট পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার চকরহিমাপুর পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে।
আজ বেলা তিনটায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে একই সময়ে ঘাঘটের পানি বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার, করতোয়ার পানি ১২৯  সেন্টিমিটার ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপরে এবং ঘাঘট, করতোয়া ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সব নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে চরাঞ্চল থেকে পানি নামতে সময় লাগবে।