ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২২ সালে সন্তান জন্মদানের সময় ৯১ জন নারীর মৃত্যু হয়।
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার পুরুইল গ্রামের মিনা বেগমের সন্তান হয় ময়মনসিংহ নগরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। সন্তান হওয়ার তিন দিন পর ক্লিনিক থেকে ছুটি দিলে বাড়ি চলে যান মিনা বেগম। বাড়ি যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উচ্চমাত্রায় খিঁচুনি শুরু হয়। তখন তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মিনা বেগমের মতো অনেকে প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী জটিলতায় ভোগেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা বা প্রসূতিকে একেবারে শেষ সময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২২ সালে সন্তান জন্মদানের সময় ৯১ জন নারীর মৃত্যু হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, পরিবারের মানুষের সচেতনতার অভাবে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।
এ পরিস্থিতিতে আজ রোববার আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে আগামীকাল সোমবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কনফারেন্স কক্ষে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক, উপপরিচালক ও চিকিৎসকেরা অংশ নেবেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের সামনে কথা হয় অসুস্থ মিনার স্বামী নুরুল হকের সঙ্গে। নুরুল হক জানান, তিনি একজন কৃষক। সন্তান প্রসবের সময় প্রতিবেশী এক নারীর পরামর্শে স্ত্রীকে সরকারি হাসপাতালে না নিয়ে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেন। সেখানে তাঁরা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। সব মিলিয়ে তাঁদের ১৩ হাজার ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে। এখন তাঁর স্ত্রীর শরীরও ভালো নেই।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্র জানায়, নুরুল হকের মতো বিভিন্ন গ্রামের মানুষ অন্যের প্ররোচনায় সন্তান প্রসবের আগে যান বেসরকারি ক্লিনিকে। ক্লিনিকগুলোতে নেওয়ার পর বেশির ভাগ নারীর সন্তান প্রসব করা হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। তবে বছরে কটি অস্ত্রোপচার বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে হয়, এর পরিসংখ্যান নেই সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে।
গত বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ক্লিনিকগুলোতে সন্তান জন্মের পরিসংখ্যান দিতে বললেও তা সঠিকভাবে দেয় না। তবে তাঁরা ক্লিনিকগুলোকে এ ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। জেলার ১১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য সেবা চালু রয়েছে। তবে অনেকে এ সেবা না নিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে যান। মানুষের এ ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ তিন মাসে (ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল) ১১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩ হাজার ৫৮২টি স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। পাশাপাশি অস্ত্রোপচার হয়েছে ৭৮টি। এর মধ্যে মুক্তাগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাভাবিক প্রসব বেশি। এখানে তিন মাসে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৮৮৫ নারীর। অস্ত্রোপচার হয়েছে মাত্র ১৩টি।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান বেশি হচ্ছে। ২০২২ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৬ হাজার ৫৭২টি। আর অস্ত্রোপচার হয়েছে ৭ হাজার ৯৮১টি। ২০২২ সালে সন্তান জন্মদানের সময় ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের গাইনি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, জটিল প্রসবের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একেবারে শেষ সময়ে অন্তঃসত্ত্বাদের এখানে আনা হয়। যে কারণে অনেকেই মারা যান। গ্রামের মানুষের বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালে সঠিক এবং দ্রুত চিকিৎসা পান না রোগীরা। রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে উঠলে ক্লিনিকগুলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেয়। শেষ সময়ে রোগী এলে তাঁদেরও কিছু করার থাকে না।
একটি বেসরকারি ক্লিনিকের মালিক বলেন, ময়মনসিংহের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য খরচ করতে হয় ১৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ রোগীর স্বজনদের কিনতে হয়।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার অ্যাসোসিয়েশনের ময়মনসিংহ শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুনসুর আলম বলেন, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না দেখে কোনো ক্লিনিকেই অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ভর্তি করার কোনো নিয়ম নেই। ভর্তির পর ক্লিনিকগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করা হয়। সেটা সম্ভব না হলে অস্ত্রোপচার হয়।