পাঁচ বছর ধরে এভাবে শিকলবন্দী হয়ে দিন কাটছে হামিদুল ইসলামের। শনিবার নাটোরের নলডাঙ্গার উপজেলার ব্রহ্মপুর এলাকায় হামিদুলের নানার বাড়ির আঙিনায়
পাঁচ বছর ধরে এভাবে শিকলবন্দী হয়ে দিন কাটছে হামিদুল ইসলামের। শনিবার নাটোরের নলডাঙ্গার উপজেলার ব্রহ্মপুর এলাকায় হামিদুলের নানার বাড়ির আঙিনায়

নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে আহত হয়ে ৫ বছর ধরে শিকলবন্দী হামিদুল

নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয় ১০ বছরের শিশু হামিদুল ইসলাম। টাকার অভাবে দরিদ্র বাবা জহুরুল ইসলাম ছেলের তেমন একটা চিকিৎসা করাতে পারেননি। শারীরিক অসুস্থতার চার বছরের মাথায় হামিদুলের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর নিরুপায় হয়ে মা–বাবা ছেলের পায়ে শিকল পরিয়ে দেন। গত পাঁচ বছরে সেই শিকল আর খোলা হয়নি।

হামিদুলদের বাড়ি নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পশ্চিম মাধনগরের বামনপাড়া গ্রামে। শিকলবন্দী হামিদুলের সারাটা দিন কাটে নানার বাড়ির খোলা আঙিনায় একটা আমগাছের সঙ্গে। লম্বা শিকলের এক প্রান্ত বাঁধা থাকে গাছের গোড়ায়। অন্য প্রান্ত তার পায়ের নিচের অংশে বাঁধা। শিকল পরেই ভেজা মাটিতে বসে থাকা, ঘুমানো ও খাওয়াদাওয়া।

বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, হামিদুলের বয়স তখন ১০ বছর। ২০১৪ সালে ব্রহ্মপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছিল। ২ নম্বর ওয়ার্ডে সদস্যপদে প্রার্থী হয়েছিলেন প্রতিবেশী উজ্জ্বল হোসেন। সবার অগোচরে শিশু হামিদুল তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পায় সে। স্থানীয় চিকিৎসককে দিয়ে চিকিৎসা করাতে থাকেন। কাটাছেঁড়া ভালো হয়ে যায়, কিন্তু মাথার ব্যথা ভালো হয়নি। এর চার বছর পর মানসিক রোগীতে পরিণত হয় হামিদুল। দৌড়ে রাস্তায় চলে যেত, একে–ওকে মারত, ভাঙচুর করত। বাধ্য হয়ে ওর পায়ে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়। এখন তিনি ১৯ বছরের তরুণ। কিন্তু অস্বাভাবিক আচরণ আরও বেড়েছে। কখনো কাঁদেন, কখনো হাসেন। এমনকি রাতের বেলায় ঘুম থেকে উঠে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর জন্য মা–বাবা পালা করে জেগে থাকেন।

মা হাজরা বেগম বলেন, দুই ছেলের মধ্যে হামিদুল বড়। পড়ালেখা ভালো করত, তবে দুরন্ত ছিল। সেই দুরন্ত ছেলেকে শিকলবন্দী করে রাখতে তাঁর বুক ফেটে যায়। খাবার সামনে দিলে কখনো খায়, কখনো ফেলে রাখে। উন্নত চিকিৎসা করালে হয়তো হামিদুলকে ভালো করা যেত। কিন্তু আর্থিক সংগতি তাঁদের নেই।

হাজরা বেগম বলেন, ‘ওর বাবা অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করত। ছেলেকে দেখাশোনার জন্য এখন কাজে যেতে পারে না। এখন আমাদের দুই বেলা খাবারই জোটে না। নিরুপায় হয়ে আমি স্বামী–সন্তান নিয়ে আমার বাপের বাড়িতে এসে উঠেছি। বাপ বাঁশের ঝুড়ি বানায়ে বিক্রি করেন। তাঁর পক্ষেও আমাদের পালা সম্ভব হচ্ছে না।’

হাজরা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘যার ভোটের প্রচারণায় গিয়ে ছেলে আমার পাগল হয়ে গেল, তিনিও আমার ছেলের খোঁজ নেন না। সরকারের কোনো ভাতাও পাই না। প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছি। ভাতা পেলে অন্তত খাবার কেনার কিছুটা কাজে আসত।’

ইউপি নির্বাচনের সেই সদস্য পদপ্রার্থী উজ্জ্বল হোসেন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি তো ওই নির্বাচনে জিততে পারিনি। আমার আর্থিক অবস্থাও ভালো না। তা ছাড়া আমি তো হামিদুলকে আমার প্রচারণায় যেতে বলিনি। সে নিজের ইচ্ছাতেই গিয়েছিল।’

নলডাঙ্গা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুমন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, হামিদুলের ব্যাপারে তাঁরা জেনেছেন। তাঁর নামে একটা প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। তবে তাঁর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা স্থানীয়ভাবে সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।