ইটভাটার পাশে কয়লার স্তূপ রাখা হয়েছে। এসব কয়লা দিয়েই ভাটায় ইট উৎপাদিত হয় বলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে আসা লোকজনকে দেখানো হয়। আসলে ভাটায় ইট উৎপাদিত হচ্ছে বনাঞ্চলের কাঠ পুড়িয়ে।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ বাজারের উত্তর পাশে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা একটি ইটভাটার এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথাগুলো বলছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আরআইএম-১ ব্রিকস নামের ওই ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, ১০-১২ জন শ্রমিক ইট তৈরি করছেন। ভাটার পাশে মাটি ও কয়লার স্তূপ। শ্রমিকেরা বলেন, এসব মাটি দূরের পাহাড় ও ফসলি জমির ওপরের অংশ (টপসয়েল) কেটে আনা হয়েছে ইট তৈরির জন্য।
আট বছর আগে ওই ভাটা করেন রামুর বাসিন্দা রফিক উদ্দিন। বনাঞ্চলের পাশে হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ইটভাটা করেছেন দাবি করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাটা বনাঞ্চলের পাশে হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিচ্ছে না। কয়লা পুড়িয়ে ভাটায় ইট উৎপাদিত হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার টেকনাফ, রামু, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ১০৪টি। এর মধ্যে ৩১টি ইটভাটা তৈরি হয়েছে বনাঞ্চলের ভেতরে ও পাশে। ১০৪টি ভাটার মধ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স নেই ৫৪টির। ৬ থেকে ১৫ বছর ধরে ভাটাগুলোতে ইট উৎপাদন চলছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ২০ নভেম্বর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অবৈধভাবে তৈরি ৫৪টি ইটভাটা বন্ধের সুপারিশ করে পরিবেশ অধিদপ্তরের শীর্ষ মহলে তালিকা পাঠানো হয়। সম্প্রতি একাধিক অভিযান চালিয়ে ১০-১২টি ভাটায় ইট উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। অবশিষ্ট ভাটাগুলোরও ইট উৎপাদন বন্ধ করা হবে। ম্যাজিস্ট্রেট ও লোকবলসংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় তাঁদের জনবল রয়েছে ৯ জন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন কর্মকর্তা। উপজেলা কিংবা মাঠপর্যায়ে তাঁদের কোনো কর্মী নেই।
রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ বাজারের পাশের আরআইএম-১ ব্রিকসের কিছুটা দূরে বনাঞ্চলের পাশে আরএমএল ব্রিকস নামের আরেকটি ইটভাটা রয়েছে, যেটিরও নেই পরিবেশ ছাড়পত্র।
ভাটার মালিক রামুর বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে কয়েক বছর আগে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বনাঞ্চলের পাশে ভাটা স্থাপন করা হয়েছে—এই অজুহাতে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিচ্ছে না। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় জেলা প্রশাসন থেকে ইট উৎপাদনের লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও স্থানীয় চাহিদা পূরণে ভাটায় ইট উৎপাদন করছেন বলে দাবি করেন তিনি।
রামুতে ঘুরে ও বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার কাউয়ারকুপ ইউনিয়নের বনাঞ্চলের পাশে আধা কিলোমিটারের মধ্যে তৈরি হয়েছে আরও ১৪টি ইটভাটা। এভাবে রামু উপজেলার ১১ ইউনিয়নে ইটভাটা রয়েছে ৪০টি। এর মধ্যে অবৈধ ভাটা ২৫টি।
২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। আইনে বলা আছে, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভায়রণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষিজমিতে ইটভাটা করা যাবে না। ইট উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলা থেকে মাটি কেটে কাঁচামাল ও জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারও নিষিদ্ধ।
চকরিয়া উপজেলার হারবাং বনাঞ্চলের পাশে এলবিএম ব্রিকস নামের একটি ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড় কাটা মাটি ট্রাকে করে আনা হয়েছে। শ্রমিকেরা সেই মাটি দিয়ে তৈরি করছেন ইট। এই ভাটাতেও কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। দৈনিক ১০-১২ ট্রাক ইট সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি ইটের দাম ৯ থেকে ১০ টাকা। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পাওয়া ভাটাটির মালিক শামসুল আলম দাবি করেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে ভাটাটি করেছেন তিনি।
চকরিয়ার দক্ষিণ হারবাং বনাঞ্চলের পাশে তৈরি আরিফ উদ্দিনের আশিক ব্রিকস, ফাঁসিয়াখালীর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীর জিএলবি ব্রিকস, মানিকপুরের মাহমুদুল হকের আল মদিনা ব্রিকস, শাহ আলমের ডায়মন্ড ব্রিকস, গয়ালমারার শামশুল আলমের এবিএম ব্রিকস—কোনোটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। তবু চলছে ইট উৎপাদন। মালিকদের দাবি, বনাঞ্চলের পাশে হলেও ভাটার জায়গা তাঁদের।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চকরিয়া উপজেলায় ইটভাটা আছে ৫২টি। এর মধ্যে ৩৬টি ভাটার কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। কয়েকটি ভাটার লাইসেন্স থাকলেও তা কয়েক বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ। টেকনাফে দমদমিয়া, জাদিমুরা, হ্নীলা, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ইটভাটা আছে ১৯টি। এর মধ্যে ৯টি ভাটা তৈরি হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাছে ও পাহাড়ের পাদদেশে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জেলার টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া ও কক্সবাজার সদর উপজেলার অন্তত ৬০টি ইটভাটার কোনো লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। অথচ প্রতিদিন ভাটাগুলোতে ইট উৎপাদিত হচ্ছে ২০ লাখের বেশি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উচ্ছেদের তালিকায় অবৈধ ৫৪টি ভাটা থাকলেও রহস্যজনক কারণে উচ্ছেদ হচ্ছে না। ভাটাগুলোয় বনাঞ্চলের কাঠ পুড়িয়ে উৎপাদিত হচ্ছে ইট। ভাটাগুলোর চিমনিও মান্ধাতার আমলের। কাঠ ব্যবহারের ফলে একদিকে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে কালো ধোঁয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। নষ্ট হচ্ছে গাছের ফলমূল ও পাখির আবাসস্থল।
কক্সবাজার (উত্তর) বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আনোয়ার হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বেশির ভাগ ড্রাম চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটা—অথচ এসব চিমনি ২০০১ সালে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ভাটায় ফসলি জমির ওপর স্তরের মাটি ব্যবহার করায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পচ্ছে। কমছে ফসল উৎপাদন ক্ষমতাও।