মাঠের এক পাশে তৈলাক্ত একটি বাঁশ। তার ঠিক ওপরে একটি মোবাইল ফোন রাখা। তৈলাক্ত সেই বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছেন কয়েকজন। অনেক চেষ্টার পর একজন বাঁশ বেয়ে জিতল মোবাইল। আরেক পাশে তির-ধনুক নিয়ে তির ছুড়ছেন কয়েকজন তরুণ। কেউ আবার গুলতি দিয়ে সামনে রাখা লক্ষ্যে ছুড়ে মারছেন। নারীরা অবশ্য এসব প্রতিযোগিতায় নেই। তাঁরা ব্যস্ত পান গোছানোর প্রতিযোগিতায়। মাঠের মাঝে রাখা পান কে কত কম সময়ে গোছাতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন তাঁরা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জির মাঠে এমন নানা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বর্ষবিদায় দিয়েছেন খাসিয়ারা। খাসিয়া জনগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান ‘সেং কুটস্নেম’ উপলক্ষে এ আয়োজন করে ‘খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল’। অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করে মণিপুরি ললিতকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন খাসিয়াপুঞ্জি থেকে আসা খাসিয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য সাধারণ জনগোষ্ঠীর মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
আয়োজকেরা জানান, ‘সেং কুটস্নেম’ বা বর্ষবিদায় খাসিয়াদের সর্বজনীন উৎসব। প্রতিবছরের মতো এবারও কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া পুঞ্জির খেলার মাঠে নানা সমাহারে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এদিন বর্ষবিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানান খাসিয়ারা। বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১২৪তম বর্ষকে বিদায় ও ১২৫তম বর্ষকে বরণ করে নিচ্ছেন তাঁরা। ব্রিটিশ আমল থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ২৩ নভেম্বর ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ পালন করা হয়। ২৪ নভেম্বর থেকে শুরু হবে খাসি বর্ষবরণ।
দুপুরে মাগুরছড়া ফুটবল মাঠে বাঁশের খুঁটির ওপর প্রাকৃতিক পরিবেশে নারকেলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হয় মঞ্চ। আলোচনা সভার মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জির মান্ত্রী (গ্রামপ্রধান) জিডিসন প্রধান সুচিয়াংয়ের সভাপতিত্বে ও লাউয়াছড়া খাসিয়াপুঞ্জির প্রধান ফিলা পতমির সঞ্চালনে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়নাল আবেদীন। এতে কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় চক্রবর্তী, বাংলাদেশ মণিপুরি সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
বর্ষবরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে খাসিয়ারা তাঁদের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে আদি পাহাড়ি নৃত্য ও গান করেন শিল্পীরা। পাশাপাশি তাঁদের জীবিকার প্রধান উৎসব জুমচাষ ও জীবন-জীবিকার বিভিন্ন পদ্ধতি নৃত্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন। উৎসব উপলক্ষে সকাল থেকে মাগুরছড়া পুঞ্জির মাঠে বসে ঐতিহ্যবাহী মেলা। মেলায় খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোকেরা বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, পান, তির, ধনুকসহ বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়।
খাসিয়া সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে বাঙালি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা অংশ নেন। উৎসবে আসা সোমা দাশ প্রথম আলোকে বলেন, খাসিয়াদের এ উৎসবে তিনি এবারই প্রথম এসেছেন। অনুষ্ঠানে এসে তিনি খাসিয়া সম্প্রদায়ের অনেক কিছু দেখতে পেয়েছেন। উৎসবে এসে তাঁর অনেক ভালো লেগেছে।
উৎসব আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ফিলা পতমি প্রথম আলোকে বলেন, খাসি সেং কুটস্নেম বাংলায় করলে হয় খাসি বর্ষবিদায়। ১৮৯৯ সাল থেকে খাসি জনগোষ্ঠীর লোকজন অনুষ্ঠান করলেও বাংলাদেশে তাঁরা ২০১১ সাল থেকে আয়োজন করছেন। ব্রিটিশ আগ্রাসনে যখন আদিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতি হুমকির মধ্যে পড়েছিল, তখন কয়েকজন খাসিয়া তরুণ এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই দিনটি ছিল ২৩ নভেম্বর। সেই থেকে দিনটি তাঁরা পালন করছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবার আয়োজন কিছুটা সীমিত করা হয়েছে।