মেয়েটি মেধাবী ও সুন্দর। ছেলেটি সুদর্শন। তাঁরা দুজন সহপাঠী। দুজনেই চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। প্রথম দেখায় ছেলেটি মেয়েটির প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে পড়া তরুণ ছেলেটি তাঁর মনের আকুলতার কথা জানাতে দ্বিধাবোধ করেন। কীভাবে জানাবেন তাঁর হৃদয়ের কথা? মেয়েটিও ছেলেটির চোখেমুখে অন্য রকম একটি অভিব্যক্তি লক্ষ করেন। তবে দুজনের মনের এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা হয় না। সময় গড়িয়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিকের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
গল্পটা ১৯৭৭ সালের। এর মধ্যে সময় গড়িয়ে গেছে বহুদূর। পৃথিবীটা পাল্টে গেছে বহুভাবে। সেই ছেলেটি পড়ালেখা শেষ করে এখন দেশের নামকরা শিল্পপতি। আর মেয়েটি চিকিৎসক। ৪৬ বছর পর তাঁদের দেখা হয়েছে রাঙামাটির হ্রদের ধারে সবুজ পাহাড়ের নির্জন পাদদেশে। জীবনের বিকেলবেলায় তারুণ্যে ফিরে এসে তাঁরা যেন পুরোনো সেই প্রশ্নের একটা মীমাংসা পেয়েছেন। তত দিনে অবশ্য তাঁদের যাঁর যাঁর নিজস্ব একটি জীবন রচিত হয়ে গেছে। সবকিছু পেছনে রেখে তাঁরা গানে, স্মৃতিকথায় আর খেলাধুলায় তিন দিন ব্যস্ত ছিলেন এক জমজমাট পুনর্মিলনীর আসরে। ফিরে গেছেন চট্টগ্রাম কলেজের তারুণ্যের স্বর্ণময় দিনগুলোতে।
শুধু এই দুজন নন, পুনর্মিলনীতে প্রাণে প্রাণ মিলিয়েছেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা প্রথিতযশা স্বনামধন্য শতাধিক মানুষ। চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ১৯৭৭ ব্যাচের সংগঠন ভালোবাসার ৭৭ এই পুনর্মিলনীর আয়োজন করেছে। ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি তিন দিনব্যাপী এই আয়োজন শুরু হয় প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজের প্রাঙ্গণ থেকে। ১২ জানুয়ারি সকালে এখানে সবাই জড়ো হন প্রথমে। সেখান থেকে রওনা দেন রাঙামাটির উদ্দেশে।
এরপর রাঙামাটির একটি পর্যটনকেন্দ্রে তিন দিন আনন্দে সময় কাটান তাঁরা। ভালোবাসার ৭৭-এর অন্যতম সংগঠক নৌ প্রকৌশলী এস এম এ হান্নান বলেন, ‘আমাদের ৭৭ ব্যাচের অনেক বন্ধু সারা জীবন নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে, নানা ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। দেশ ও দশের সেবা করেছেন। এখনো কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থেকে কাজ করছেন। অবসরে কিংবা অবসরের কাছাকাছি এসে আমরা এখন অতীতের কথা মনে করছি। একটু তারুণ্যকে ফিরে পেতে চেয়েছি। তাই এই আয়োজন।’
৭৭ ব্যাচের আরেকজন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চাকরিজীবনে এতটা ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে সবকিছু ভুলতে বসেছিলাম। তিনটি দিন এখানে কাটিয়ে মনে হচ্ছে, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটালাম।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল হালিমও একই আবেগ প্রকাশ করে বললেন, ‘রাঙামাটি হ্রদের জলে নিজের তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি দেখলাম।’ ইয়ং ওয়ানের আইনি উপদেষ্টা এ টি এম আফতাব উদ্দীন বললেন, ‘পুরোনো বন্ধুদের পেয়ে মনে হলো আমার চট্টগ্রাম কলেজের সময়ের বয়স ফিরে পেয়েছি।’
ভালোবাসার ৭৭-এর আরেকজন সংগঠক নাজমুল আলম চৌধুরী মিয়া বললেন, ‘সেরা সেরা চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, আইনজীবী, ব্যাংকার, কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পপতি থেকে শুরু করে বিচিত্র রকম পেশার মানুষ আছে আমাদের ব্যাচে। তাদের জন্য দেশ যেমন গর্বিত, আমরাও গর্বিত।’
এই ব্যাচের একজন এসএ গ্রুপের কর্ণধার শিল্পপতি শাহাবুদ্দিন আলম বলেন, ‘এখানে এসে দুনিয়ার সব ঝামেলা ভুলে গেছি। এ ধরনের উদ্যোগ জীবনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।’
আনন্দ আয়োজনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন গুলশান রহমান ও রাফি সৈয়দ, কানাডা থেকে আসাদুল আশরাফ, মালদ্বীপ থেকে নাজনীন আনোয়ার।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্যে স্থানীয় চাকমা শিল্পীদের ঐতিহ্যবাহী গান আর নাচ সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
তবে ৭৭ ব্যাচের অন্যতম সহপাঠী জনপ্রিয় রেনেসাঁ ব্যান্ডের তারকা নকীব খানের গান সবাইকে মোহিত করে রাখে। নকীব খান বলেন, ‘কতশত মঞ্চে গান করেছি এই জীবনে। কিন্তু কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে থেকে, তাদের নিয়ে গান করার যে আনন্দ, তার তুলনা হয় না!’ এই ব্যাচের আরেক গায়ক শাহরিয়ার খালেদও গানে গানে মাতিয়ে রেখেছিলেন। বয়স যা-ই হোক, তারুণ্যের রং ছড়ানো তিনটা দিন যেন বন্ধু-সহপাঠীদের সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করল।