নোয়াখালীর হাতিয়ার হরণী ইউনিয়নের হাতিয়া বাজারের গরুর হাট। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তোলা
নোয়াখালীর হাতিয়ার হরণী ইউনিয়নের হাতিয়া বাজারের গরুর হাট। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তোলা

দখল হয়ে গেল গরুর বাজারও

দলের নাম ভাঙিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার হরণী ইউনিয়নে একটি গরুর বাজার দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এ পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে বাজারে টোল আদায় করতে পারছেন না সরকারিভাবে দায়িত্ব পাওয়া ইজারাদার ও তাঁর প্রতিনিধি। বিষয়টি নিয়ে ইজারাদারের প্রতিনিধি স্থানীয় ও জেলা প্রশাসনের কাছে ধরনা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার অভাবে বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ মার্চ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় থেকে হাতিয়ার হরণী ইউনিয়নের হাতিয়া বাজার এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয় আবদুল হক নামের এক ব্যক্তিকে। তিনি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বাজারটি ইজারা নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে বাজার দেখাশোনা ও টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মো. ইসমাইল হোসেন (৫৫) ও মো. আবদুর রহমানসহ (৪৮) ১২ জনকে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামা করে দায়িত্ব অর্পণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁরা কয়েক মাস ধরে নিয়মিত খাজনা ও টোল আদায় করছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একই এলাকার আঁতর আলী, নোয়াব আলী, আর্শাদ আলীসহ একদল লোক নিজেদের বিএনপি নেতা দাবি করে হাট দখল করে হাসিল ও টোল আদায় শুরু করেন।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন গিয়েও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গরুর বাজার থেকে হাসিল এবং অন্যান্য বাজার থেকে টোল আদায় করতে দেখা যায়। অভিযুক্ত আঁতর আলী হরণী ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি। মঙ্গলবারও তিনি দলবল নিয়ে গরুর বাজারে হাসিল আদায় তদারকি করছিলেন। আলাপকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের লোকজন এই বাজার দখলে রেখেছেন। ৫ আগস্টের পর তারা পালিয়ে গেছেন। মাঝখানে তিনটি হাটের দিন তাঁরা টোল আদায় করেছিলেন। পরে আবার পালিয়ে গেছেন। এরপর তিনি মূল ইজারাদার আবদুল হকের কাছ থেকে লিখিত দায়িত্ব পেয়ে টোল আদায় করছেন।

বাজারের মূল ইজারাদার আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বাজারের ইজারা পাওয়ার পর ইসমাইল ও আবদুর রহমানসহ ১২ জনকে তাঁর পক্ষে বাজার থেকে টোল আদায়ের যাবতীয় ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন। এর বাইরে কারও সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হয়নি। তিনি আঁতর আলী কিংবা অন্য কাউকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর আঁতর আলীসহ কিছু লোক তাঁর লোকজনকে বাজারে টোল আদায় করতে দিচ্ছেন না। নিজেরাই বাজারের টোল আদায় করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যাচ্ছেন। আবদুল হক জানান, তিনি ইসমাইলসহ যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁরা এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও থানায় অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এখনো কোনো প্রতিকার পাননি।

মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাদের পক্ষে ইজারা নেওয়া বাজার তিন মাসের বেশি সময় ধরে বিএনপির পরিচয় দিয়ে একদল দখল করে টোলের টাকা আদায় করছেন। মো. ইসামাইল জানান, বাজার দখলের বিষয়ে তাঁরা ৫ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। জেলা প্রশাসক সেটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠিয়েছেন। ইউএনও পাঠিয়েছেন থানায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁদের বাজার অবৈধ দখলমুক্ত করতে পারেনি প্রশাসন। অথচ ইজারার সব টাকাই তাঁরা কার্যাদেশ পাওয়ার আগে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন।

হরণী ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলতাফ হোসেন দাবি করেন, যাঁরা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে বাজার দখল করেছেন তাঁরা বিএনপির কেউ নন। তাঁরা একসময় আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পর রাতারাতি তাঁরা নিজেদের খোলস পাল্টে বিএনপি বনে গেছেন। বিএনপির কোনো পর্যায়ে তাঁদের কোনো পদ–পদবি নেই।

হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা বাজার দখল করে রেখেছেন, তাঁরা দাবি করছেন তাঁরাও মূল ইজারাদারের কাছ থেকে বাজারের টোল আদায়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি উভয় পক্ষকে কাগজপত্র নিয়ে থানায় আসতে বলেছেন। কাগজপত্র নিয়ে থানায় এলে যাচাই–বাছাই করে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাজারে নিয়মিত গরুর ব্যবসা করেন ব্যাপারী লক্ষ্মীপুরের রামগতির মো. সোলেমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি অনেক বাজারে নিয়মিত গরু–মহিষের বেচাকেনা করেন। কিন্তু হাতিয়া বাজার ছাড়া আশপাশের উপজেলারও কোনো বাজারে এমন অবস্থা তিনি দেখেননি। এখানে কিছু লোক আগের ইজারাদারের লোকজনকে হটিয়ে নিজেরা বাজার দখল করে ইচ্ছেমতো টোল আদায় করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতাদের নাজেহাল করছেন। লাখ লাখ টাকার লেনদেন করতে হয় তাঁদের। এখন তাঁদের কোনো নিরাপত্তা নেই। এ কারণে গত তিন মাসে অনেক ব্যাপারী এই বাজারে পশু আনাও কমিয়ে দিয়েছেন।