নিজের বাড়ি থেকে অন্যের বারান্দায়, অশীতিপর শাকিলার ঠাঁই হলো বৃদ্ধাশ্রমে

শাকিলা বেগম
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর ব্যস্ত শহরে বাড়ি থেকে অশীতিপর মা শাকিলা বেগমকে বাসে তুলে দিয়েছিলেন ছেলে ও ছেলের বউ। বাসে তুলে দেওয়ার সময় ছেলে মাকে বলেছিলেন, ‘তুমি আর কখনোই বাড়িতে আসার চেষ্টা করবে না।’ গভীর রাতে শাকিলা বেগমকে দিনাজপুরের হিলি শহরে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অন্যের বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নেন তিনি। বারান্দার খোলা বাতাস ও অর্ধাহারে অসুস্থ হলে জায়গা হয় স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গণমাধ্যমের বদৌলতে অবশেষে তাঁর ঠাঁই হয়েছে ‘সাফল্যের গল্প শোনাব’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে।

আজ রোববার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অমিত রায়ের উপস্থিতিতে একটি প্রতিনিধিদল শাকিলা বেগমকে রংপুর শহরের ওই বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যায়। গণমাধ্যমে শাকিলা বেগমের অসহায়ত্বের কথা জানতে পেরে বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ হাকিমপুর উপজেলা প্রশাসন ও থানা-পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হয়, বৃদ্ধাশ্রমটি রংপুর জেলা সমাজসেবা দপ্তর থেকে নিবন্ধিত এবং রংপুর মহানগর পুলিশের উপপরিদর্শক রেজাউল করিম ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিয়মিত দেখভাল করেন। পরে উপজেলা প্রশাসন ওই বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শাকিলা বেগমকে সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

১৪ জুলাই রাত আনুমানিক ১০টার পরে হিলি স্থলবন্দরের সিপি সড়ক এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলামের বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলেন শাকিলা বেগম। তিনি তাঁর নিজের ও একমাত্র ছেলের নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেননি। কয়েক বছর আগে তাঁর স্বামী মারা যান। ছেলের বাসা ঢাকা শহরে। সেখানেই থাকতেন। তবে ছেলের বাসা ঢাকা শহরের কোথায়, সেটি বলতে পারেননি। বলতে পারেননি স্বামীর নামও।

অশীতিপর শাকিলাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর সময় হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন উর রশিদসহ প্রশাসনের লোকজন

ছেলে জামিল হোসেন ও ছেলের বউ বাড়িতে প্রায়ই মানসিক নির্যাতন করতেন অভিযোগ করে শাকিলা বলেছিলেন, কয়েক দিন আগে ছেলে ও ছেলের বউ একটি ব্যাগে পরনের কিছু কাপড়চোপড় ভরে তাঁর হাতে দিয়ে শহর থেকে একটি বাসে তুলে দেন। বাসে তুলে দেওয়ার সময় ছেলে তাঁকে বলেন, ‘তুমি আর কখনোই বাড়িতে আসার চেষ্টা করবে না। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাও।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ‘বাসে তুলে দেওয়ার পর আমি ও বাসের হেলপার ছেলের কাছে মোবাইল নম্বর চাইছিলাম। কিন্তু সে তাঁর নম্বর দেয়নি। বাসের ড্রাইভার আমাকে এখানে নামাইয়ে দিছে।’

বারান্দায় আশ্রয় দেওয়া বাড়ির মালিক রবিউল ইসলাম বলেন, ওই বৃদ্ধা ৯ দিন ধরে খোলা জায়গায় থেকে ও পরিবারকে হারিয়ে অনেকটা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিষয়টি হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) জানানো হয়। তাঁদের পরামর্শে শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। পরিবারকে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানে অন্তত স্বাস্থ্যসেবা ও খাবার পাবেন—ভেবে তিনি এমনটি করেছেন।

ইউএনও অমিত রায় বলেন, স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে ওই বৃদ্ধার কথা জানতে পারেন। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। বিষয়টি তিনি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকেও জানান। পরে জেলা প্রশাসক ও হাকিমপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পরামর্শে ওই বৃদ্ধার দেখভালের জন্য তাঁর পরিবারের কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত সরকারের নিবন্ধিত বৃদ্ধাশ্রমে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে আজ বিকেলে শাকিলা বেগমকে রংপুর শহরের ‘সাফল্যের গল্প শোনাব’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হয়।

অশীতিপর শাকিলা বেগমকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর সময় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন উর রশিদ, ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনুর রেজা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শ্যামল কুমার দাস, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাসুদ রানা ও থানার ওসি আবু সায়েম মিয়া প্রমুখ।