রমজানের বাজার

‘ভাত খাবার টাকা নাই, আরও ফলমূলের আলাপ করিছু’

রমজানকে কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন আমেনার মতো স্বল্প আয়ের মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুর সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান ফটকের সঙ্গে লাগোয়া একটি টংদোকানে বসে আছেন আমেনা বেগম। এই দোকানের মালিক তিনি। স্বামী নেই। তাই সংসারের খরচ জোগাড় করতে এই ব্যবসা বেছে নিয়েছেন চল্লিশোর্ধ্ব এই নারী। চা–বিস্কুট আর পান–সিগারেট বিক্রি করেন আমেনা। তবে রমজান মাসে বাড়তি লাভের আশায় দোকানে কলা ও মুড়ি বিক্রি করবেন।

আজ শুক্রবার সকালে আলাপে জানা গেল, প্রতিবেশীর কাছে এক হাজার টাকা ঋণ করে কলা ও মুড়ি তুলেছেন তিনি। দোকানের পাশাপাশি রমজান মাসে নিজের কিংবা পরিবারের জন্য পুষ্টিকর কোনো খাবার বা ফলমূলের বন্দোবস্ত করবেন কি না, জানতে চাইলাম। তাচ্ছিল্যের সুরে আমেনা বললেন, ‘সারা দিন দোকান করিয়া চাল-ডাল কিনির টাকায় হয় না। যা দিন পড়োছে। ভাত খাবার টাকা নাই, আরও ফলের আলাপ করিছু, ভাই! তার উপুর তো রোজা–রমজান মাস, দোকানত বেচা বিক্রিও নাই। মৌসুমে কেউ আম-লিচু কিনে দিলে খাওয়া পড়ে। এরপর আর কোনো ফল চোখে পড়ে না।’

আমেনা বেগমের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ফলমূল খাওয়া এখন অনেকটা বিলাসিতার মতো। বাজারের অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মতো ফলের দামও লাগামহীন। এর মধ্যে রমজানকে কেন্দ্র করে গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দু–একটি বাদে প্রায় সব ফলের দাম বেড়েছে। তাই যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরাও ফলের দোকানে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন।

দিনাজপুর শহরের পৌরসভা রেলগুমটি এলাকার ফল ব্যবসায়ী মোমিনুল হক (৩৮) বলেন, দাম বাড়ায় অনেক নিয়মিত ক্রেতাই দোকানে আসছেন না। যাঁরা আসছেন, তাঁরাও পরিমাণে কম কিনছেন। ফল তো বেশি দিন রাখা যায় না। নির্দিষ্ট সময় পরে পচতে শুরু করে।

মোমিনুলের দোকানে এক কেজি আপেল কিনলেন আল মামুন (৪২)। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। মামুন বলেন, ‘ফলের দাম অনেক বেশি। ১৮০ টাকার আপেল কিনতে হলো ৩৫০ টাকা দিয়ে। মাসে যা বেতন পাই, তা দিয়ে বর্তমানে সংসারের খরচই হয় না। ছেলের আবদার রাখতে তিন দিন পর বাজারে এলাম।’

ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে ফল সাজিয়ে রাখছেন এক বিক্রেতা। আজ শুক্রবার সকালে শহরের পৌরসভা রেলঘুন্টি এলাকায়

দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার, পৌরসভা রেলগুমটি, গোর-এ-শহীদ মাঠে রাস্তার পাশে ফলের দোকান বসে। আজ শুক্রবার সকাল থেকে বাজার ঘুরে দেখা যায়, জাতভেদে প্রতি কেজি আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ৪০০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগেও যেখানে আপেলের দাম ছিল ১৫০-৩২০ টাকার মধ্যে। একইভাবে কমলার দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া তরমুজের দাম প্রতি কেজি ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫৫ টাকায়, পেয়ারা ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, মাল্টা ২০০ থেকে বেড়ে ২৬০ টাকা, আঙ্গুর (সবুজ) ২৪০ থেকে টাকা বেড়ে ৩০০ টাকা, আঙ্গুর (কালো) ৩৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রমজান এলেই চাহিদা বেড়ে যায় খেজুরের। তাই দামও আকাশচুম্বী। বাহাদুর বাজারে ফল বিক্রেতা মানু হোসেন জানান, প্রতি কেজি মাবরুম খেজুর ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়, ডাল খেজুর ৬০০ টাকা, দাব্বাস ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ও লুলু ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

বেশি দামে মাল আমদানি করতে হচ্ছে। প্রতি কার্টন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ডলারের বাড়তি দাম, সেই সঙ্গে পরিবহন খরচও বাড়ছে।
না‌সিম খান, সাধারণ সম্পাদক, দিনাজপুর ফল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমবায় স‌মি‌তি

গোর-এ-শহীদ ময়দানে রাস্তার পাশের ফলের দোকান থেকে কলা কিনে ব্যাগে ভরলেন আবদুস সালাম। এরপর তরমুজের দাম জিজ্ঞেস করলেন। দাম শুনেই তরমুজ কেনার আগ্রহে ভাটা পড়ল সালামের। তিনি বলেন, ‘গতবছর যে সেমাই ৬০ টাকা কেজি কিনছি, আজকে বাহাদুর বাজারে এক কেজি সেমাই কিনলাম ১০০ টাকায়। আধা কেজি খেজুর কিনতে হলো ৩৫০ টাকা দিয়ে। এক হালি কলা ৪০ টাকা। কোনো কিছু কেনার সাধ্যই নাই। পরিমাণে কম আর বেশি কী!’

দিনাজপুর ফল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমবায় স‌মি‌তির সাধারণ সম্পাদক না‌সিম খান ব‌লেন, কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম বাড়তি। বেশি দামে মাল আমদানি করতে হচ্ছে। প্রতি কার্টন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ডলারের বাড়তি দাম, সেই সঙ্গে পরিবহন খরচও বাড়ছে। যে পরিমাণ মাল আনার কথা, দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরাও সে পরিমাণ মাল আনতে পারছেন না। সব মিলিয়ে ফলের দাম বাড়তি।