‘হঠাৎ কইর্যা বিরাট একটা শব্দ কইর্যা চালের উপার গাছটা ভাইংগ্যা পড়ছে। মুহূর্তের মধ্যে বুকটা কাঁইপ্যা উঠছে। আমার মাইয়াডা গাছের নিচে চাপা পড়ে যায়। ডাক-চিৎকার হুইন্যা মানুষ দৌড়াইয়া আইয়া মাইয়াডারে উদ্ধার করছে।’ এসব কথা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠলেন দীপালী রানী ডাকুয়া।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া শহরের রহমতপুর এলাকায় দীপালির বাড়ি। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে গত সোমবার গভীর রাতে একটি চম্বলগাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর থাকার টিনের দোতলা বসতঘরটি। গাছের চাপে পাশের রান্নাঘরটিও ধসে পড়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এবারের ঝড়ে বেশি উপড়ে পড়েছে চম্বলগাছ। এর বাইরে রেইনট্রি, মেহগনি, গামারি, আকাশমণি, কড়ইসহ ছোট ছোট বিভিন্ন প্রজাতির গাছ উপড়ে পড়েছে। তবে এ উপকূলের চাকামইয়া, টিয়াখালী, নীলগঞ্জ, মহিপুর, লতাচাপলী, ধুলাসার ও চম্পাপুর ইউনিয়নে বেশ কিছু আমবাগানেরও ক্ষতি হয়েছে। বন বিভাগের কলাপাড়া ও মহিপুর রেঞ্জের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ৭২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডবে বাগানের আমও পড়ে গেছে।
নীলগঞ্জ ইউনিয়নের সলিমপুর গ্রামের বাসিন্দা বাদল মাতুব্বর বলেন, তাঁর চম্বল-মেহগনি-রেইনট্রি মিলিয়ে ৩০-৩৫টি গাছ ঝড়ে পড়ে গেছে। তবে এর মধ্যে বেশি উপড়ে পড়েছে চম্বলগাছ। এলাকার নুর হোসেন হাওলাদারের বসতঘরের ওপর একটি বড় চম্বলগাছ পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশে ছিল একটি গভীর নলকূপ, সেটাও উপড়ে গেছে।
গাছের ক্ষয়ক্ষতির পরিপূর্ণ হিসাব এখনো সেভাবে পাওয়া যায়নি। তবে বন বিভাগের কলাপাড়া ও মহিপুর রেঞ্জের আওতাধীন এলাকার প্রাথমিক একটি হিসাব পাওয়া গেছে। ব্যক্তিপর্যায়ের গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি কী পরিমাণ হয়েছে, তা উপজেলা প্রশাসন থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। কলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মনিরুল হক বলেন, তাঁর রেঞ্জের আওতাধীন ২০ হেক্টর ঝাউবাগান, গোলপাতার বাগান, বন বিভাগের সহায়তায় নির্মিত ৩০০টি বসতবাড়ির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ, সরকারি আবাসন, পুকুরের পাড়, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রান্তিক পর্যায়ে এক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, ১৭০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ গাছ এবারের ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ লাখ টাকা।
মনিরুল হক আরও বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে বহু মানুষের গাছপালা উপড়ে পড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার সঠিক হিসাব নিরূপণ করা যায়নি। আগামী দিনে গাছপালার এমন ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পুনরায় বনায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জের অধীনে রয়েছে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা, লতাচাপলি, ধুলাসার, মহিপুর, ডালবুগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের একাংশসহ বেশ কিছু এলাকা। কী পরিমাণ গাছপালার ক্ষতি হয়েছে, তা জানার জন্য রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল করা হয়, কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। তবে জেলা কার্যালয় থেকে একটি প্রাথমিক হিসাব পাওয়া গেছে। তাতে দেখা যায়, ১০ হাজার একর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ লাখ টাকা।
জাতীয় সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরার (ধরা) এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ঘন ঘন আসবে এবং ক্রমে শক্তিশালী হবে, এটা আমরা এত দিন বুঝতাম। ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষেত্রে এবার আমরা দেখলাম, ঝড় দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে এবং অবস্থান পরিবর্তন করেছে ধীরে ধীরে। এটা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন অভিঘাত।’
শরীফ জামিল আরও বলেন, কলাপাড়া-কুয়াকাটা এলাকাটিতে একসময় যে প্রাকৃতিক বর্ম (সুরক্ষা ব্যবস্থা) ছিল, সেটা ক্রমে বিলীন করে ফেলা হয়েছে। একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর ম্যানগ্রোভ (শ্বাসমূলীয়) বন ছিল, সেসব ধ্বংস করা হয়েছে। ফলে উপকূল আজ চরমভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে যেভাবে গাছপালা উপড়ে পড়েছে, সে ক্ষতি কাটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিটি গ্রামীণ সড়ক ও বড় রাস্তার পাশে পরিকল্পনা করে গাছ লাগাতে হবে। উপকূলকে রক্ষা করতে হলে বেশি করে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে গাছ লাগানোর মাধ্যমে বন তৈরি করা যায় না, বনায়ন করা যায়। মূলত বন নিজে নিজে তৈরি হয়। তাই বনের জায়গা ধ্বংস করা যাবে না।