‘৩০ বছর ধরে ইস্টিশনে জুতা পালিশ (জুতা পলিশ) করে সংসার চালাই। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা ইনকাম হয়। এই টাকায় সাত সদস্যের সংসার ভালোই চলে। আমরা দিন আনি দিন খাই। আমগর বেশির ভাগের জমানো টাকা থাকে না। এই যে দুই সপ্তাহ ধইরা ট্রেন চলাচল বন্ধ, আমরা এখন অনেক কষ্ট করে জীবন চালাচ্ছি। হাতে টাকাপয়সা নাই, ঘরে খাওন নাই। একটা ট্রেন দিছে, কিন্তু যাত্রী নাই। তাই একটি টাকাও ইনকাম নাই। এভাবে ট্রেন বন্ধ থাকলে আমরা চলমু কেমনে।’
আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন জুতা পলিশকারী (মুচি) সামছুল হক (৪৮)। জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসেন তিনি। সাধারণত ট্রেনের যাত্রীরা তাঁর কাছ থেকে জুতা পলিশ করে নেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুলাই থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁর মতো হাজারো স্টেশন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও হকারের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জামালপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। হকাররা প্ল্যাটফর্মে নেই। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তেমন কোনো যাত্রীও নেই। প্রধান ফটকটিও তালাবদ্ধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আছেন। বেসরকারি কমিউটার ট্রেনটি চালু করা হলেও স্টেশনে কোনো যাত্রী নেই। ১৩ দিন পর রেলস্টেশনে এসেছেন সামছুল হক। জুতা পলিশ করতে প্ল্যাটফর্মে বসে আছেন। কিন্তু সারা দিনে একটি টাকাও রোজগার করতে পারেননি। সব ট্রেন চলাচল না করায় তিনি বিপাকে পড়েছেন।
সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই ছেলেসহ সাতজনের সংসার। একটা পুলা (ছেলে) মধ্যে মধ্যে শ্রমিকের কাজ করে। কিন্তু আমার ইনকাম দিয়েই সবাই চলি। দুই সপ্তাহ ধরে আমার রোজগার বন্ধ। সকালে শুনলাম, আজ (বৃহস্পতিবার) একটা ট্রেন চলবে। পরে সবকিছু নিয়ে সকাল থেকে বসে আছি। কোনো মানুষ নাই। ট্রেন আইছিল। কিন্তু যাত্রী নাই। এভাবে কেমনে চলমু। হাতে টাকাপয়সা নাই। ঘরেও খাবার নাই। আর কত দিন এভাবে চলবে, সেটাও বুঝতে পারছি না।’
স্টেশনের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামালপুর রেলস্টেশন ঘিরে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে শতাধিক দোকান আছে। স্টেশন ঘিরেই তাঁদের ব্যবসা। এ ছাড়া এই স্টেশন ঘিরে প্রায় শতাধিক হকারও আছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৮ জুলাই থেকে সংঘাত শুরুর পর তাঁদের আয়রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তাঁরা পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন।
স্টেশনের বাদাম বিক্রেতা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আয়রোজগার বন্ধ। কেমনে চলুম। আজ (বৃহস্পতিবার) একটা ট্রেন আইছিল। তাই ইস্টিশনে আইছিলাম। ইস্টিশনে দুই-একজন যাত্রী ছিল। খুব কষ্টের মধ্যে আছি। একটা টেহাও (টাকা) ইনকাম নাই। ট্রেন চললে দৈনিক ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার বাদাম বিক্রি করতাম। এখন স্টেশন ও আশপাশের এলাকা ঘুরেও ১০০ টাকার বাদাম বিক্রি করতে পারি না। দীর্ঘদিন হকারি করায় অন্য কোনো কাজও পাচ্ছি না।’
স্টেশনে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন আরও কয়েকজন মুচি। তাঁরা বলেন, দেশে কিছু হলেই নিম্ন আয়ের তাঁদের মতো মানুষের মরণ। দেশে কয়েক দিন পরপর বিশৃঙ্খলা হলেই সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। তখন নিম্ন আয়ের মানুষের খাওয়াদাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। দেশে যখনই হানাহানি, তখনই বিপদে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষজন। স্টেশনে জুতা সেলাই করে দিনে এনে দিনে খান। এখন ট্রেন নেই, লোকজন নেই। তাঁদের আয়ও নেই। তাঁরা কত কষ্টে আছেন, তাঁদের খবর কেউ রাখেন না।
স্টেশন প্ল্যাটফর্মের ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ রাসেল মিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য একদম বন্ধ আছে। একটি বেসরকারি ট্রেন চলাচল শুরু করেছে, কিন্তু যাত্রী নেই। আগে দিনে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার ফল বিক্রি করতেন। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে দোকানই খুলতে পারেননি। কারণ, সব ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। একটি ট্রেন চলাচল করলেও যাত্রী না থাকায় দোকান খোলেননি। পরিবার নিয়ে কষ্টের মধ্যে আছেন বলে জানান তিনি।
জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার শেখ উজ্জ্বল মাহমুদ বলেন, জামালপুর-ঢাকা, জামালপুর-চট্টগ্রাম রেলপথে ছয় জোড়া আন্তনগর ট্রেন নিয়মিতভাবে চলাচল করে থাকে। এ ছাড়া এক জোড়া লোকাল ও দুই জোড়া মেইল ট্রেন চলাচল করে। প্রতিদিন ওই সব ট্রেনে ১০ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। গতকাল শুধু বেসরকারি কমিউটার ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। অন্যান্য ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে।