বরিশাল সিটি করপোরেশন
বরিশাল সিটি করপোরেশন

বরিশাল সিটি করপোরেশন

জরুরি সেবা ব্যাহত, ভোগান্তিতে মানুষ

  • সিটি করপোরেশনের ৩০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১৪ জনই নেই।

  • এসব কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যুসনদ, নাগরিকত্ব সনদ সরবরাহ বন্ধ।

  • শিগগিরই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বেশির ভাগ কাউন্সিলর। এরপর বিভাগীয় কমিশনার মো. শওকত আলী গত ১৯ আগস্ট সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর না থাকায় জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যু সনদ, সনদ সংশোধন, নাগরিকত্ব সনদ সরবরাহসহ নানা ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকেরা।

সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যুসনদ, সনদ সংশোধন, নাগরিকত্ব সনদ, চারিত্রিক সনদ, উত্তরাধিকার (ওয়ারিশ) সনদ, ভূমিহীন সনদ, টিসিবি কার্ড, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদসহ বিভিন্ন সনদ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে বিভিন্ন প্রত্যয়নপত্র, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর দিতে হয় কাউন্সিলরকে।

মামলা থাকাসহ নানা কারণে সিটি করপোরেশনের ১৪টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আত্মগোপনে। মানুষ নানা ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এসব সনদ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সই প্রয়োজন। নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মশক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের তদারকি এবং টিসিবির পণ্য বিতরণের কাজও পরিচালিত হয় কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে। কিন্তু কাউন্সিলররা আত্মগোপনে থাকায় তাঁদের কার্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাগ্রহীতারা।

নগরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শীতলাখোলা এলাকার বাসিন্দা মানসুর আলী ছেলের জন্মনিবন্ধন করানোর জন্য বেশ কয়েক দিন ধরে দৌড়ঝাঁপ করছেন। নিজের জন্মনিবন্ধন না থাকায় ছেলেরটাও করাতে পারছেন না। কিন্তু ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নইমুল হোসেন গত ৫ আগস্ট সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বাড়িতে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর তাঁর কার্যালয় বন্ধ। পরে জন্মনিবন্ধনের জন্য যান এলাকার নারী কাউন্সিলরের কাছে। নারী কাউন্সিলর তাঁকে জানান, জন্মনিবন্ধন করার জন্য সার্ভারের যেসব আইডি, পাসওয়ার্ড প্রয়োজন সেগুলো তাঁদের দেওয়া হয়নি। এরপর তিনি নগর ভবনে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে পাশের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে যেতে বলা হয়। ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলর আত্মগোপনে থাকায় সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন মানসুর। সচিব তাঁকে জানান, সার্ভারের আইডি ও পাসওয়ার্ড এখনো তাঁকে দেওয়া হয়নি। এক সপ্তাহ ধরে ঘুরেও কোনো সুরাহা পাননি তিনি।

একই ওয়ার্ডের নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনও একই ভোগান্তির কথা জানান। ২০ নম্বর ওয়ার্ডের খ্রিষ্টান কলোনির এক নারী জানান, তাঁর বাবার মৃত্যু সনদের জন্য তিনি প্রায় এক মাস ধরে ঘুরছেন, কিন্তু পাননি। জরুরি এই সনদ প্রয়োজন হলেও তিনি না পেয়ে সমস্যায় পড়েছেন। একইভাবে ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজ অ্যাভিনিউ এলাকার আরেক যুবক জানান, তিনি চাকরির জন্য আবেদন করবেন। এ জন্য তাঁর নাগরিক সনদ দাকার। কিন্তু কাউন্সির আত্মগোপনে থাকায় ঘুরেও পাচ্ছেন না। নগরের অন্তত ১৪টি ওয়ার্ডের নাগরিকেরা এখনো এমন সমস্যার মধ্যে আছেন।

১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘১৯ নম্বর ওয়ার্ডের নিবন্ধন কার্যক্রম আমাদের এখানে দেওয়া হলেও আমরা এখনো আইডি ও পাসওয়ার্ড পাইনি। তাই সেবাগ্রহীতারা এলেও সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।’

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, আগে জন্মনিবন্ধন সনদ, মৃত্যু সনদ, নাগরিকত্ব সনদ সরবরাহসহ বিভিন্ন সেবা নগরের সদর রোডের বিবির পুকুরপাড়ের এনেক্স ভবন থেকে দেওয়া হতো। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নাগরিকদের সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের কার্যালয় থেকে এসব সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এসব সেবা প্রদান করা হতো। এ জন্য সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সার্ভারের আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে নগরে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে যান। কয়েকজন কাউন্সিলরের কার্যালয় বিক্ষুব্ধ লোকজন পুড়িয়ে দেন। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর আগুনে পুড়ে মারা যান। অন্যদিকে বিএনপির দায়ের করা পৃথক তিনটি মামলায় আসামি হয়েছেন অন্তত ১৭ জন কাউন্সিলর। এসব কাউন্সিলর প্রথম কয়েক দিন এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। পরে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করলে গত ২৩ আগস্ট বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান বাদী হয়ে বরিশাল কোতোয়ালি থানায় ৩৮১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ১৩ জন কাউন্সিলরকেও আসামি করা হয়েছে। এই খবরে আবার গা ঢাকা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলররা। এরপর আরও দুটি মামলা হয়েছে। সেখানেও বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর আসামি হয়েছেন। এতে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২৪ জন কাউন্সিলর আত্মগোপনে এবং একজন কাউন্সিলর আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ায় এসব ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা ভেঙে পড়ে।

নগরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সামজিদুল কবির বাবু প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় আসামি হওয়া ১০ জন কাউন্সিলর উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে এসেছেন।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে যাতে সেবা ব্যাহত না হয় সে জন্য সিটি করপোরেশনগুলোর প্রশাসকদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে যেসব ওয়ার্ডে কাউন্সিলরগণ অনুপস্থিত সে ক্ষেত্রে পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে এই সেবা দেওয়ার ক্ষমতা দিতে পারবেন প্রশাসকেরা।

এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন গবলেন, ‘আমরা দু-এক দিনের মধ্যে এটা দিয়ে দেব। আশা করি দ্রুত এ ভোগান্তি লাঘব হবে।’