ছয় বোনের পর দুই ভাই। এ জন্য ফয়সাল সরকার ও ফাহাদ সরকার দুজনই ছিলেন ছয় বোনসহ পরিবারের সবার আদরের। বাবা বৃদ্ধ, তাই পরিবারের হাল ধরতে পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন ফয়সাল। ছিলেন একটি পরিবহনের বাসের সুপারভাইজার। এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ফয়সাল কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করছেন।
গত ১৯ জুলাই বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন ফয়সাল। কিছুক্ষণ পর থেকেই পরিবারের সদস্যরা তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পান। এর পর থেকেই খোঁজ নেই ২০ বছর বয়সী এই তরুণের। এভাবেই কেটে যায় অন্তত ১২ দিন। তাঁর সন্ধানে দিশাহারা স্বজনেরা তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে জানতে পারেন, ফয়সাল আর পৃথিবীতে নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে প্রাণ গেছে তাঁর। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে নির্মম মৃত্যু হয়েছে ফয়সালের। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় ছিল, ছয় বোনসহ পরিবারের সদস্যদের আদরের ফয়সালের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
ফয়সালের বাড়ি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কাচিসাইর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের সফিউল ইসলাম ওরফে রেজা মিয়ার ছেলে। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। এদিন রাতে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন, ফয়সাল সরকার জিপিএ–৪.৩৫ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
ফয়সাল এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করেছেন, এ খবর জানার পর থেকেই বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগমের কান্না থামছে না। আজ বুধবার সকালে মুঠোফোনে হাজেরা বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি বারবার ছেলের জন্য আক্ষেপ করছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাজেরা বলেন, ‘আমার পোলাডা ভালো ছাত্র আছিল। ইন্টার পরীক্ষায় পাস কইরাও দেইখ্যা যাইতারলো না। এই দুঃখ কেমনে সামলাইতাম। আমার বুকটা ফাইট্টা যাইতাছে। আমার এত আদরের পোলাডারে বেওয়ারিশ হিসাবে কবর দিল। শেষবার পোলাডার মুখটাও দেখতে পারলাম না।’
ফয়সাল রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার এস এম মোজাম্মেল হক টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসিও পাস করেন তিনি। সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন ফয়সাল। থাকতেন রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়।
ফয়সালের তৃতীয় বোন রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমাদের ছয় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ফয়সাল ছিল সবচেয়ে বেশি আদরের। আমার সেই আদরের ভাইটাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো। আমার বাবা খুব অসুস্থ, কানে কম শোনেন। ফয়সাল পাস করেছে শুনে চোখের পানি ফেলছেন আর কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পেরেছি, পুলিশের গুলিতেই আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে।’
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই বিকেলে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয় ফয়সাল। ওই দিন সন্ধ্যার পর তাঁর মুঠোফোন নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পান পরিবারের সদস্যরা। এরপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণখান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এভাবে কেটে যায় ১২ দিন। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ১ আগস্ট বিকেলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে সেখানে কর্মরতরা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা মরদেহগুলোর ছবি দেখান। এরপর সেখানে ফয়সালের মরদেহের ছবি দেখতে পান স্বজনেরা। আঞ্জুমানে কর্মরত ব্যক্তিরা পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, অন্তত ১৫টি মরদেহ একসঙ্গে গণকবর দিয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে ফয়সালও ছিলেন।
আজ সকালে ফয়সালের ভগ্নিপতি আবদুর রহিম সরকার বলেন, ‘ফয়সালের পরীক্ষায় পাসের খবরে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। আমার বড় শ্যালকটা অনেক মেধাবী ছিল। চাকরির পাশাপাশি সামান্য পড়েই পরীক্ষায় ভালো ফল করত। তাদের বাড়িতে একটি টিনের ঘর ছাড়া কিছু নেই। ফয়সাল পড়াশোনার পাশাপাশি যা আয় করত, তা দিয়ে পরিবারটি চলত। আন্দোলনে ফয়সাল নিহত হওয়ায় পুরো পরিবারটি এখন অসহায়।’
ফয়সালের ছোট ভাই একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহাদ সরকার বলেন, ‘আমি ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতাম। সেখানে পড়াশোনা করতাম। কিন্তু ভাই নিহত হওয়ার পর থেকে এক দিনও ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনি। এখন ঢাকা যেতে ভয় লাগে। তাই কুমিল্লা চলে এসেছি। দেবীদ্বারের বাগুর বাসস্ট্যান্ডে আমার ভগ্নিপতির দোকানে এখন কাজ করছি।’