একসময় কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার অংশ। বিশেষ করে কুমিল্লার লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়ি এলাকাগুলো ছিল ত্রিপুরা সম্প্রদায় অধ্যুষিত। তবে কুমিল্লার ত্রিপুরাদের কাছে সেই সময় এখন অনেকটাই স্মৃতির মতো। কারণ, টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যেতে হচ্ছে তাদের। ত্রিপুরাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের ভাষা, পেশা ও সংস্কৃতিও এখন ঝুঁকির মুখে।
বুধবার সকালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সালমানপুর ত্রিপুরা পল্লি ঘুরে দেখা গেছে, নানা সংকট আর সমস্যায় দিন কাটছে ত্রিপুরাদের। তাদের প্রধান পেশা জুমচাষ হলেও এই পাহাড়ে জুমচাষের কোনো অস্তিত্ব নেই। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে অনেক ত্রিপুরা এখন দিনমজুরের কাজ করছেন। নামে ত্রিপুরা পল্লি হলেও সালমানপুরে অন্য ধর্মের মানুষজনও বসতি গড়েছেন। বর্তমানে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিজেদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করছেন ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, পাহাড়ের সালমানপুর, জামমুড়াসহ আশপাশে এলাকায় চারটি ত্রিপুরা পল্লি আছে। এই চার পল্লিতে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষ বসবাস করছেন। ত্রিপুরা পল্লিগুলোতে গেলেই এখনো চোখে পড়ে প্রাচীন মাটির ঘরের। পল্লির ভেতরে চলাচলের জন্য তেমন কোনো রাস্তা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই পাহাড়ের লাল মাটিগুলো কাদায় পরিণত হয়। তখন কাদা মাড়িয়ে চলাচলে দুর্ভোগের শেষ থাকে না বাসিন্দাদের। ওই ত্রিপুরা পরিবারগুলোর নেই কোনো ধর্মীয় মন্দির। মৃত্যুর পর মরদেহ সৎকারের জন্য নেই শ্মশানও। সেখানে গেলে মনে হয় সংকটের যেন শেষ নেই। তবে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা ‘ককবরক’ রক্ষায় সালমানপুরে টিন দিয়ে এক কক্ষের একটি ঘর নির্মাণ করেছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা প্রশাসন। ‘ত্রিপুরা পল্লি ককবরক মাতৃভাষা স্কুল’ নাম বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সালমানপুর ত্রিপুরা পল্লির বাসিন্দা মনিন্দ্র চন্দ্র ত্রিপুরা।
মনিন্দ্র ত্রিপুরা দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরাদের অধিকার ও জীবনমান উন্নয়নে কথা বলছেন। ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ বলেন, লালমাই-ময়নামতি পাহাড়টি অন্তত ১২ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে। একসময় পুরো পাহাড়ই ছিল ত্রিপুরাদের। কিন্তু এখন ত্রিপুরারাই এখানে সংখ্যালঘু। এখন ত্রিপুরাদের প্রতিনিয়ত টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রধান আয়ের উৎস পাহাড়ে জুমচাষ। কুমিল্লায় এখন কোথাও জুমচাষ নেই। ত্রিপুরাদের বেশির ভাগ সম্পত্তিই বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে। বর্তমানে বাসিন্দাদের ভিটামাটি ছাড়া কিছুই নেই। পল্লির বেশির ভাগ লোক এখন দিনমজুরের কাজ করে। প্রতিনিয়ত ইতিহাস-ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ওই পল্লির বাসিন্দা সুভাষ ত্রিপুরার ছেলে সুমন ত্রিপুরা বলেন, ‘ত্রিপুরা এখন আমাদের নামের সঙ্গেই টিকে আছে। আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। বেকারত্ব আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের এখানে একটি শ্মশানও নেই। বৃদ্ধরা চিন্তায় থাকেন, মৃত্যুর পর কীভাবে মরদেহ সৎকার হবে। পল্লির ভেতরে চলাচলের জন্য রাস্তা নেই। সব মিলিয়ে আমাদের সমস্যার শেষ নেই।’
সীমা রানী ত্রিপুরা নামের এক গৃহিণী বলেন, ‘আমরা তেমন লেখাপড়া করতে পারিনি। বর্তমানে কর্মজীবী পুরুষদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত। তাই আমরা চেষ্টা করছি সন্তানদের পড়াশোনা করানোর।’
সালমানপুর ত্রিপুরা সম্প্রদায় কল্যাণ সমবায় সমিতির সভাপতি সজীব চন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ত্রিপুরা পল্লির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জরুরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। পাশাপাশি বেকার ছেলেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে ত্রিপুরা সম্প্রদায় গৌরবের সঙ্গে টিকে থাকতে পারবে।
কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ত্রিপুরার রাজধানী ছিল ভারতের উদয়পুর আর কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরা জেলার সদর দপ্তর। ত্রিপুরারা দুই ধারার, সমতল ত্রিপুরা ও পার্বত্য ত্রিপুরা। কুমিল্লা অঞ্চলে যাঁরা বসবাস করছেন, তাঁরা সমতলের ত্রিপুরা। ত্রিপুরার রাজারা একসময় কুমিল্লা অঞ্চলে জমিদারি করেছেন। এক শ বছর আগেও কুমিল্লা অঞ্চলে ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষা ও তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রচলন ছিল। পাশাপাশি এ অঞ্চলে বাংলা ভাষারও প্রচলন ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ও পরে কুমিল্লা অঞ্চলের ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভারতের ত্রিপুরায় চলে যান। ত্রিপুরাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (সার্বিক) চলতি দায়িত্বে থাকা ফাহমিদা মুস্তফা বলেন, ‘ত্রিপুরা পল্লিতে মৃত্যুর পর সৎকারের জন্য শ্মশান নেই, বিষয়টি আপনার মাধ্যমেই জানলাম। এটিসহ অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আমরা খোঁজখবর নেব। ত্রিপুরা পল্লির মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কীভাবে আমরা কাজ করতে পারি, সেটি নিয়ে জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।’