চারদিকে সবুজ ফসলের মাঠ। বসন্ত বাতাস বইছে। পড়ন্ত বিকেলে বাতাসে দোল খাচ্ছে কচি ধানের পাতা। সবুজের মাঝে একচিলতে মাঠ। মাঠে হাজারো মানুষ। মঞ্চে বাউলশিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গাইছেন বাউল করিমের জনপ্রিয় গান। গানের সুর ছড়িয়ে পড়ে উজানধলের বসন্ত বাতাসে, কালনী নদীর জলে-ঢেউয়ে।
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের জন্মস্থান সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামের মাঠে বৃহস্পতিবার বিকেলে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ‘শাহ আবদুল করিম লোক উৎসব’। শাহ আবদুল করিম পরিষদ ও উজানধল গ্রামবাসীর আয়োজিত উৎসবে সহযোগিতা করছে মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি উজানধল গ্রামে জন্ম নেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।
শাহ আবদুল করিম পরিষদের সভাপতি ও শাহ আবদুল করিমের ছেলে বাউল শাহ নূর জালালের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী। অন্যান্যের মধ্যে বিকাশের হেড অব ডিপার্টমেন্ট (রেগুলেটরি অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) হুমায়ুন কবির, দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুর রহমান খন্দকার, শাহ আবদুল করিম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ধ্রুপদ চৌধুরী, স্থানীয় কুলঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একরার হোসেন, ভাটি বাংলা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি আবদাল হোসেন, স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পারমিতা দাস।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, শাহ আবদুল করিমকে ভালোবাসে বলেই মানুষ তাঁর টানে এখানে ছুটে আসেন। মানুষের কল্যাণ, মানুষের মুক্তিই করিমের দর্শন ও গানের মূল কথা। তাঁর সৃষ্টিকর্মের চর্চা বাড়াতে হবে। এই উজানধলের বসন্ত বাতাসে, তাঁর প্রিয় নদী কালনীর জলে-ঢেউয়ে মিশে আছেন শাহ আবদুল করিম। মানুষই ছিল করিমের ধ্যানজ্ঞান। শাহ আবদুল করিম লোক উৎসব হলো সাম্য-মৈত্রীর মিলন উৎসব।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, বাউল শাহ আবদুল করিমের সৃষ্টি ও কর্ম ধরে রাখতে বাউল শাহ আবদুল করিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবে জেলা প্রশাসন।
বিকাশের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা গর্বিত ও আনন্দিত বাউল শাহ আবদুল করিমের মতো একজন গুণীকে নিয়ে আয়োজিত উৎসবে সম্পৃক্ত হতে পেরে। দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব ভালো উদ্যোগে পাশে আছে বিকাশ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বিকাশ কাজ করছে। বাউল করিম হচ্ছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি।
উদ্বোধন শেষে মঞ্চে বাউলসম্রাটের জনপ্রিয় গান গাইতে শুরু করেন তাঁর শিষ্যরা। সেই গানে নেচে-গেয়ে মাতোয়ারা হন দূরদূরান্ত থেকে আসা করিম–ভক্তরা। বয়সের ব্যবধান যেন ঘুচে যায় গানের টানে। উৎসবের উদ্বোধনী দিনে গান গেয়ে শোনান বাউল রণেশ ঠাকুর, আবদুর রহমান, সিরাজ উদ্দিন, প্রাণ কৃষ্ণ, লাল শাহ, আজগর আলী, শিপন আহমদ, আবদুল তোহায়েদ, শান্তা সরকার, শারমিন প্রমুখ।
শিল্পীরা বাউল করিমের ‘বসন্ত বাতাসে সই গো’, ‘বন্ধুরে কই পাব সখী গো’, ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান...’, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে...’, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে, দিওয়ানা বানাইছে...’, ‘গাড়ি চলে না চলে না রে...’, ‘তুমি আমার আমি তোমার...’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু...’, ‘তুমি বিনে আকুল পরান...’, ‘তুমি মানুষ আমি মানুষ...’,‘ আসি বলে গেল বন্ধু আইল না...’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন।
বাংলা লোকগানের এই বাউলসম্রাটের স্মরণে ২০০৬ সাল থেকে এ উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। উৎসবে সারা দেশ থেকে আসা ভক্ত-সাধকদের পাশাপাশি সংগীতপ্রেমীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে উজানধল। কাল শুক্রবার উৎসব শেষ হবে।