রাজপ্রতাপের মায়ের বিলাপ

‘আমি আমার সোনামানিক হত্যার বিচার চাই, ফাঁসি চাই’

নিহত ছাত্র রাজপ্রতাপের মা মমতা দাসকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা
ছবি: প্রথম আলো

বাড়িভর্তি মানুষ। সবাই সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছেন মমতা দাসকে সান্ত্বনা দিতে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। উল্টো তাঁর বিলাপে চোখে পানি চলে আসছে অন্যদের। ‘আমার সোনাকে সুস্থ অবস্থায় স্কুলে পাঠালাম। ছাত্ররা ভুল করবে। শিক্ষকেরা সংশোধন করবে। তাদের মানুষ করবে। তা না করে আমার সোনাকে পিটিয়ে হত্যা করল। আমি আমার সোনামানিক হত্যার বিচার চাই। ফাঁসি চাই।’

এ চিত্র আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় কালীগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমুলিয়া ইউনিয়নের চণ্ডীপুর গ্রামের কিশোর রাজপ্রতাপ দাসের (১৫) বাড়ির। গতকাল রোববার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র রাজপ্রতাপ দাস অসুস্থ হয়ে মারা যায়।

পরিবার ও সহপাঠীদের অভিযোগ, স্কুলে জন্মদিনের কেক কাটা নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজপ্রতাপকে মারধর করেন। পরে সে বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক ওই ছাত্রকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনা তদন্তে আজ পৃথক দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মমতা ও দীনবন্ধু দাস দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে রাজপ্রতাপ ছিল বড়। তাঁদের ছোট ছেলে রুদ্র দাস ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সে–ও ভাইয়ের সঙ্গে নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে।

মমতা দাস চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি কাকে নিয়ে বেঁচে থাকব? তোমরা আমার ছেলেকে এনে দেও। বাড়িতে এসে সোনামানিক রাজপ্রতাপ বলে আমার বুকে ব্যথা করছে। এরপরই রক্তবমি করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।’

মা মমতার আর্তনাদে যখন আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে, তখন রাজপ্রতাপের বাবা দীনবন্ধু দাস ও চাচা দেবীরঞ্জন দাস নির্বাক বসে ছিলেন। কোনো কথা ছিল না তাঁদের মুখে।

চাচাতো বোন শ্রীপা দাস খুলনা বিএল কলেজের ছাত্রী। তাঁর কান্নাও থামছে না। বারবার তিনি বলছেন, তাঁর ভাই কী অপরাধ করেছে যে তাকে পিটিয়ে মারতে হবে। যে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, ওই বিদ্যালয় থাকার কী দরকার? তিনি তাঁর ভাইয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চান।

নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে

এর আগে আজ বেলা ১১টার দিকে নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বন্ধ বিদ্যালয়ে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। বিদ্যালয় চত্বরে পড়ে আছে গতকাল আগুনে পোড়ানো মোটরসাইকেলের অংশবিশেষ। পড়ে আছে বিদ্যালয় ভাঙচুর করা কক্ষের কাচ ও আসবাবপত্র। বিদ্যালয়ে ঢুকতে না পেরে অর্ধশত ছাত্র বাইরে অপেক্ষা করছে।

নিহত ছাত্রের কয়েক সহপাঠী জানায়, তারা রাজপ্রতাপ ‘হত্যার’ প্রতিবাদ করতে বিদ্যালয়ে এসেছে। কিন্তু বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি। পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও ইউপি সদস্য আবদুস ছাত্তার বলেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কেউ সামনে আসছেন না। সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সংসদ সদস্য আ ফ ম রুহুল হক ঢাকায় রয়েছেন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, এ ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি পেতে হবে। ঘটনাটি নিন্দনীয়।

পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন

রাজপ্রতাপের মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শেখ মঈনুল ইসলামকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অজিত কুমার সরকার জানান, তাঁরা আজ দুপুর ১২টার দিকে নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে কাউকে পাননি। অজিত কুমার আরও বলেন, জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও কালীগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইলিয়াস হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদের তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রহিমা সুলতানা বুশরা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজাহার আলী ও ভাড়াশিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. নাজমুল হাসান বেলা ১১টার দিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সেখানে ইউএনও বলেন, ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি পরিবারের পাশে থাকবেন। তিনি প্রতিবেশীদেরও শোকাহত পরিবারের পাশে থাকার আহ্বান জানান।

রাজপ্রতাপ দাস

পাঁচ শিক্ষককে আসামি করে মামলা

রাজপ্রতাপের এক সহপাঠীর ভাষ্য, গতকাল তার ও এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে সকাল ১০টার দিকে বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনের একটি ফাঁকা কক্ষে রাজপ্রতাপসহ কয়েক বন্ধু মিলে জন্মদিনের কেক কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এ সময় সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এ মুহিতের সঙ্গে সেখানে আসেন অবকাশ চন্দ্র খাঁ, মনিরুল ইসলাম, সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরীসহ পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক। শিক্ষকেরা তাকে ও তার সহপাঠীদের এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন। রাজপ্রতাপের বুকে এক শিক্ষক হাঁটু দিয়ে আঘাত করেন।

পরে রাজপ্রতাপ, তাকেসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। বিদ্যালয়ে জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হচ্ছে কেন, তা বলে তাদের আবারও চড়থাপ্পড় মারা হয়। এ সময় রাজপ্রতাপ ও সে (সহপাঠী) প্রধান শিক্ষকের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তিনিও তাদের আবার চড়থাপ্পড় মেরে সরিয়ে দেন। পরে একটি কক্ষে আটকে তাদের আবারও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। এসব ঘটনার পর রাজপ্রতাপ বলে, তার শরীর খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা করছে, বমি বমি ভাব হচ্ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে। একপর্যায়ে রাজপ্রতাপ বাড়িতে চলে যায়। এর ২০ থেকে ২৫ মিনিট পরে সে শোনে, রাজপ্রতাপ মারা গেছে।

নলতা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবুল ফজল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই ছাত্রকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন সে মৃত ছিল। প্রাথমিকভাবে দেখে মনে হয়নি, সে আত্মহত্যা করেছে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, গতকাল বিকেল চারটার দিকে রাজপ্রতাপের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে তার সহপাঠীসহ এলাকাবাসী বাড়ি থেকে লাশ নিয়ে স্কুল চত্বরে ফিরে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় কয়েক শ মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা প্রধান শিক্ষকের কক্ষসহ কয়েকটি কক্ষ ভাঙচুর করেন। ১০ থেকে ১২টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন এবং ৩টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন। খবর পেয়ে কালীগঞ্জ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এদিকে আজ সকালে কালীগঞ্জ থানায় রাজপ্রতাপ দাসকে হত্যার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন রাজপ্রতাপের বাবা দীনবন্ধু দাস। মামলায় প্রধান শিক্ষক আবদুল মোনায়েম, সহকারী প্রধান শিক্ষক এম এম মুহিত, সহকারী শিক্ষক অবকাশ চন্দ্র খাঁ, মো. মনিরুল ইসলাম ও সিদ্ধার্থ রায়চৌধুরীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সহকারী শিক্ষক মনিরুল ইসলাম পলাতক।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মামুন রহমান জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা ১৫ শিক্ষকের মধ্যে গতকাল রাতেই ১১ শিক্ষককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একজন পলাতক। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।