নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য পদের উপনির্বাচনে ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। রোববার বিকেলে নিহত হৃদয় ভূঁইয়ার বড় ভাই ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আরেকটি মামলা করেছে পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ইকবাল হোসেনের করা হত্যা মামলায় জয়ী ইউপি সদস্য আবদুল আজিজ সরকারসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আর পুলিশের করা মামলায় অজ্ঞাতনামা ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত দুটি মামলার কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পিরোজপুর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর গতকাল উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে তালা প্রতীকে কায়সার আহম্মেদ ও মোরগ প্রতীকে আবদুল আজিজ সরকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ভোট গ্রহণ শেষ হয়। ভোট গণনায় কায়সার পরাজিত হলে তিনি আপত্তি তোলেন। আবার গণনা করলেও তিনি হেরে যান। প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা কার্যক্রম শেষে কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় কায়সারের সমর্থকেরা ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে কায়সারের সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। পরে আবদুল আজিজ সরকারের সমর্থকেরাও সংঘর্ষে জড়ান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। পরে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে হৃদয় ভূঁইয়া নামের ওই তরুণ নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০ জন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তাঁরা জানান, সংঘর্ষের সময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। তখনই হৃদয় ও তাঁর চাচাতো ভাই ওমর ফারুক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঘটনার সময় করা মুঠোফোনে ভিডিও করেন স্থানীয় এক তরুণ। ভিডিওটিতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হৃদয়কে কয়েকজন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় হৃদয়ের ভাই পরিচয় দেওয়া একজন বলছেন, ‘হৃদয়রে পুলিশ গুলি করছে।’
তবে এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় বলা হয়েছে, বিজয়ী ইউপি সদস্য আবদুল আজিজ সরকার লোকজন নিয়ে হৃদয় ও তাঁর চাচাতো ভাইকে গুলি করেছেন। হৃদয়ের জানাজার সময়ও তাঁর স্বজনেরা বারবার দাবি করেন, আবদুল আজিজের লোকজনের ছোড়া গুলিতে হৃদয় নিহত হয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে আবদুল আজিজ সরকার বলেন, ফলাফল ঘোষণার পর তিনি লোকজন নিয়ে আনন্দমিছিল করে বাড়িতে চলে যান। তখন হইহুল্লোড় শোনেন। পরে জানতে পারেন পরাজিত প্রার্থীর লোকজন পুলিশের ওপর হামলা করে ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি ছোড়ে। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ঘটনার পর পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পুলিশ আত্মরক্ষায় দুটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষের পর দেখা যায়, দুই তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে একজনের মৃত্যু হয়। পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে কেউ নিহত হওয়ার কথা না। নিহতের স্বজনদের দাবি, প্রতিপক্ষ গুলি করেছে। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। ওই তরুণ কার গুলিতে নিহত হয়েছে, তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
এদিকে সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু ও দুই মামলায় প্রায় ৩৫০ জনকে আসামি করার পর পুরো গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের অধিকাংশ পুরুষই এখন বাড়িছাড়া। আজ সকালে দুধঘাটা বাজারে যেতেই পুলিশের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। সড়কজুড়ে দুই প্রার্থীর পোস্টারের ছড়াছড়ি। বাজার থেকে দক্ষিণে এগিয়ে গেলে হৃদয়দের বাড়ি। আর হৃদয়দের বাড়ির ৫০০ গজ পূর্বে আবদুল আজিজের বসতি। তাঁর বাড়ির সীমানা ঘেঁষেই দুধঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই কেন্দ্রের সামনেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
দুপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে মাটিতে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা গেল। সেখানে কথা বলতে স্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয়ে ঢুকে শিক্ষার্থীদের পাওয়া গেল না। শ্রেণিকক্ষগুলো তালাবদ্ধ। বিদ্যালয়ের পাশে আবদুল আজিজ সরকারের বাড়িতে গিয়ে পুরুষ কাউকে পাওয়া যায়নি। কয়েকজন নারী একসঙ্গে বসে আলাপ করছেন।
আবদুল আজিজের ভাবি নূর জাহান প্রথম আলোকে বলেন, গতকালের ঘটনায় তাঁর দেবরসহ পরিবারের লোকজনকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এ ঘটনায় তাঁর পরিবারের কেউ জড়িত নন। তবুও পুলিশ ও নিহতের স্বজনদের ভয়ে তাঁদের বাড়ির পুরুষেরা এলাকা ছেড়েছেন। তিনি বলেন, ফলাফল দেওয়ার পর কায়সারের লোকজন ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে কায়সারের সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ ও আনসারের সংঘর্ষ হয়।