খুব কাছ থেকে গুলি করা হয় যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতার মাথায়, নেপথ্যে ইউপি নির্বাচনের ‘দ্বন্দ্ব’

লক্ষ্মীপুরে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যাচ্ছেন নেতা–কর্মীরা। বুধবার লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে
ছবি: প্রথম আলো

লক্ষ্মীপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতা নিহতের পর পরিস্থিতি অনেকটা থমথমে। জেলাজুড়ে চলছে নানা আলোচনা। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আজ বুধবার বিকেল চারটা পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসছে।

এলাকাবাসীর ধারণা, ইউপি নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যে দ্বন্দ্ব দানা বেধেছিল, তার জেরে যুবলীগ নেতা নোমান ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব খুন হতে পারেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, হামলার পর নোমান দৌড় দেন। এ সময় তাঁর পায়ে গুলি করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা খুব কাছে গিয়ে তাঁর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে।

চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলে একটি মোটরসাইকেল পড়ে ছিল। সেটি নোমান-রাকিবের। ঘটনার সঙ্গে সাত থেকে আটজন জড়িত ছিল বলে মনে হচ্ছে। জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের বিভিন্ন দল কাজ করছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাতে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান (৪০) ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম নিহত হন। রাত ১০টার দিকে সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আবদুল্লাহ আল নোমান প্রস্তাবিত জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। আর রাকিব ইমাম বশিকপুর নন্দীগ্রামের রফিক উল্যার ছেলে।

লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান (ডানে) ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমাম

নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান বশিকপুর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম জিহাদীকে দায়ী করেছেন।

মাহফুজুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যানি চাই না, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন। চিহ্নিত সন্ত্রাসী আবুল কাশেম জিহাদী পরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে হত্যা করেছে। কাশেম আমার সঙ্গে নির্বাচনে (ইউপি নির্বাচন) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরেছিল। এর পর থেকে আমাদের হুমকি দিয়ে আসছিল। টার্গেট করে নোমান-রাকিবকে তারা খুন করেছে।’

হত্যাকাণ্ডের আগে যুবলীগ নেতা নোমান পোদ্দারবাজারে ছিলেন। ওই সময় তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যদের বিদায় দিয়ে তিনি ছাত্রলীগ নেতা রাকিবকে নিয়ে মোটরসাইকেলে নাগেরহাট এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন। নাগেরহাটের কাছাকাছি পৌঁছালে সন্ত্রাসীরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর যুবলীগ নেতা নোমানকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাকিবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। পথে রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।

দলীয় নেতা-কর্মী ও নিহতের স্বজনেরা জানান, পরিকল্পিতভাবে যুবলীগ নেতা নোমানকে হত্যা করা হয়েছে। মূলত ওমরাহ থেকে গ্রামে ফেরার পরই তাঁকে টার্গেট করে প্রতিপক্ষরা। বশিকপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম জিহাদী গত বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে নোমানকে মারধরের হুমকি দিয়েছিলেন। ফলে সন্দেহের তির তাঁর (কাশেম) অনুসারীদের দিকেই যাচ্ছে।

সন্ত্রাসীদের গুলিতে ভাই নিহতের খবরে বশিকপুর ইউপির চেয়ারম্যান ও নিহত নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমানের আহাজারি। মঙ্গলবার রাতে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে

জেলা আওয়ামী লীগের অন্তত চারজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বশিকপুর ইউপির নির্বাচনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম জিহাদী। তাঁর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নিহত নোমানের ভাই মাহফুজুর রহমান। নির্বাচনে আবুল কাশেম জিহাদীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মাহফুজ। ওই নির্বাচন নিয়েই কাশেম ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে মাহফুজ-নোমানের দ্বন্দ্ব চলছিল। ওই দ্বন্দ্বের জেরে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পরে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

আওয়ামী লীগের ওই নেতাদের অভিযোগ, ইউপি নির্বাচনের দ্বন্দ্বের জেরে ‘অশান্ত’ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিষয়টি সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেননি। তাঁদের দুই পক্ষের বিরোধে জ্যেষ্ঠ নেতারা ঘি ঢেলেছেন।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আবুল কাশেম জিহাদীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও বন্ধ পাওয়া যায়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক বলেন, ‘দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের, এটা সত্য। দুই পক্ষের বিরোধের সুযোগ নিয়ে তৃতীয় পক্ষ এখানে উসকানি দিচ্ছে। কে বা কারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে কেউ দেখেনি। পুলিশের তদন্তে বিষয়টি জানা যাবে। দলের সব পক্ষকে শান্ত থাকতে বলা হয়েছে।’

এদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল রাতেই লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। ঘটনার পর এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতাকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিক্ষোভ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে লক্ষ্মীপুর শহরে

ময়নাতদন্ত শেষে আজ বেলা দেড়টার দিকে পরিবারের কাছে নোমান ও রাকিবের লাশ হস্তান্তর করা হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে বশিকপুর মাদ্রাসা মাঠে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁদের দাফন করা হয়।